• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল কুরআনে পাখির বিবরণ


তমসুর হোসেন মে ৩০, ২০১৬, ০৪:৩১ পিএম
আল কুরআনে পাখির বিবরণ

আকাশের বুকে পাখিদের উড়ে বেড়ানো আল্লাহর সৃষ্টিকুশলতার এক অপূর্ব নিদর্শন। ভোরের আলো বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে সুরের হ্মোগানে যারা কর্মমুখর দিনকে স্বাগত জানায়, সেই প্রকৃতিবান্ধব পাখিদের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলার জন্য পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহপাক পাখি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। হজরত ইব্রাহিম, ইউসুফ, দাউদ, সোলায়মান এবং ঈসা আ:-এর কাহিনীতে পাখির বিবরণ আছে। হুদহুদ নামের একটি পাখি ছিল হজরত সোলায়মান আ:-এর বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও সংবাদবাহক।

কুরআন বলে, সোলায়মান বিহঙ্গদলের সন্ধান নিলো এবং বলল, ‘ব্যাপার কী! হুদহুদকে দেখছি না যে। সে অনুপস্থিত নাকি? সে উপযুক্ত কারণ না দর্শালে আমি অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দেবো অথবা জবেহ করব। অবিলম্বে হুদহুদ এসে পড়ল এবং বলল, আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম ওদের ওপর রাজত্ব করছে। তাকে সব কিছু হতে দেয়া হয়েছে এবং তার আছে এক বিরাট সিংহাসন।’ (নামল : ২০-২৩)

পাখিকে অনুগত করে তাদের দ্বারা অতীত জমানার মতো এখনো মানুষ অনেক অকল্পনীয় উপকার গ্রহণ করে আসছে। পাখিদের গমনাগমন এবং তাদের আচার-আচরণ লক্ষ করে পরিবেশগত অনেক ধারণা মানুষ লাভ করে। পাখিরা অতি সহজে ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ালেও তাদের এ উড্ডয়ন সম্পর্কীয় বিষয়টি তুচ্ছ করে দেখার কোনো ব্যাপার নয়।

কুরআন বলে : ‘তারা কি লক্ষ করে না আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন বিহঙ্গের প্রতি? আল্লাহই ওদেরকে স্থির রাখেন। অবশ্যই এতে নিদর্শন আছে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য।’ (নাহল : ৭৯) এতদসম্পর্কে সূরা মূলকের ১৯ নম্বর আয়াতে আছে : ‘তারা কি লক্ষ করে না তাদের ঊর্ধ্বদেশে বিহঙ্গকুলের প্রতি যারা পথ বিস্তার ও সঙ্কুচিত করে? দয়াময় আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন। তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা।’

পাখিদের প্রসঙ্গে আল্লাহপাক সবিশেষ গুরুত্বসহকারে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তা হলো আকাশের শূন্য বুকে তাদের উড্ডয়ন প্রক্রিয়া। পালক আচ্ছাদিত দুটো ডানার শক্তিতে কী করে তারা আকাশমার্গের অবাধ বিস্তারে উড়ে বেড়ায়। যেসব পাখি কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বিচরণ করে তাদের কথা বাদ দিলেও যেসব পরিব্রাজী পাখি ঋতু পরিক্রমার সাথে তাল মিলিয়ে উষ্ণতর দেশের সন্ধানে মহাদেশের বিশাল দূরত্ব চষে বেড়ায় তাদের কথা গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ভাবা দরকার। তাদের দিক নির্ধারণ, যাত্রাপথে অবসর যাপন এবং দূর মনজিলে পৌঁছার সিদ্ধান্তসংক্রান্ত ভ্রমণ বিজ্ঞতার কথা কী করে উপেক্ষা করা যায়। মানচিত্র সম্পর্কে কোনো নিবিড় প্রশিক্ষণ না নিয়ে দেশ-মহাদেশ পশ্চাতে ফেলে অজানা গন্তব্যের প্রহেলিকায় হারিয়ে যাওয়া কতটুকু দু:সাহসিকতার প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে গন্তব্য পথের পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, জলাশয় এবং সাগর জঙ্গলের উত্তাল তরঙ্গমালার বিভ্রমে দিকভ্রান্ত না হয়ে আপন দেশের গভীর অরণ্যানির নিভৃত নিলয়ে তাদের সুনিপুণ প্রত্যাবর্তন কতই না রোমাঞ্চকর ও উল্লাসব্যঞ্জক।

পাওয়ার অ্যান্ড ফ্রাজিলিটি গ্রন্থে হ্যামবার্গার মাটন বার্ড সম্পর্কে এক অবাকব্যঞ্জক তথ্য দিয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই পাখিরা তাদের আবাসস্থল থেকে যাত্রা শুরু করে পনেরো হাজার মাইলেরও অধিক পথ পার হয়ে তাদের বাসস্থানে নির্বিঘেল্প ফিরে আসতে পারে। তাদের এই জটিল আকাশ যাত্রার রূপকার এবং পথ প্রদর্শক যে সর্বদর্শী, মহাকুশলী আল্লাহপাক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পাখিদের যাতে কেউ অবাধে হত্যা করতে না পারে সে জন্য এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য বার্ড ফ্লু ভাইরাস বহন করার ক্ষমতা তিনি এদের দান করেছেন। এই ভাইরাস দ্বারা এসব পরিব্রাজী অতিথি পাখি সীমিতাকারে আক্রান্ত হলেও যাত্রাপথের ঘাতক অধিবাসীদের জন্য তারা বয়ে নিয়ে যায় মৃত্যুময় শীতল হিমবার্তা।

এই নিরীহ, নান্দনিক এবং প্রকৃতিবান্ধব পাখিদের নির্বিচারে হত্যা না করার জন্য ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা: বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। যে কেউ কোনো ক্ষুদ্র পাখিকে অযথা হত্যা করলে কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর আদালতে সে কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি চড়ুই অথবা তার চেয়ে ক্ষুদ্র কোনো প্রাণী অনর্থক হত্যা করবে, আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তাকে এ হত্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! পাখির হক কী? তিনি বললেন, পাখি যখন জবাই করবে তখন তাকে খেয়ে ফেলবে। আর তার মাথা কাটার পর ফেলে দেবে না। (মিশকাত) পাখি আল্লাহর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।

গভীর অরণ্য, ধূসর মরুভূমি এবং উত্তুঙ্গ পর্বতমালায় পাখিরা ফোটায় সুরের মূর্ছনা। আল্লাহর সৃষ্টিরাজ্য সরল সজীব করে তোলার ক্ষেত্রে পাখির আছে বিশেষ অবদান। জলহীন দ্বীপ এবং মনুষ্য অগম্য নির্জন স্থানে বৃক্ষের বীজ তারাই বহন করে নিয়ে যায়। ফুলের অবাধ পরাগায়ন এবং কীট ও বালাইনাশে সক্রিয় ভূমিকা রেখে পাখিরা পৃথিবীকে প্রাণীদের জন্য নিরাপদ কাননে পরিণত করার সংগ্রামে নিয়োজিত আছে। তাদের বিষ্ঠা মাছ এবং উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট খাবার।

পাখির বিচিত্র কাকলি নিথর নিরাবেগ ধরিত্রীকে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তোলে। বন্যপ্রাণীদের দেহের পরজীবী ধ্বংস করে পাখিরা তাদের দান করে স্বস্তি ও আনন্দ। এক কথায় জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় পাখির যে একটি বিশেষ অবস্থান আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে নিগূঢ় সত্য হলো, মানুষকে মায়ামমতা, সামাজিক বন্ধন ও প্রেম-ভালোবাসা শিক্ষাদানের জন্য আল্লাহপাক পাখির নি:স্বার্থ জীবনযাত্রাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সচেতন বিবেকের সামনে। তাদের ক্ষণস্থায়ী আবাস নির্মাণ এবং সন্তান প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে যে অকৃত্রিম মমত্বের বিকাশ ঘটে তা যে করুণাময় বিশ্বপালকের অস্তিত্বের জ্বলন্ত নিদর্শন তা যেন মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারে।
দয়াল নবী সা: প্রকৃতির নন্দিত সন্তান পাখিদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আল্লাহর এ অনুপম সুন্দর সৃষ্টির প্রতি ছিল তার অতীব আকর্ষণ এবং গভীর অনুকম্পা। শুধু তাই নয়, আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি ছিল তার অগাধ প্রেম ও ভালোবাসা। হজরত আবদুর রহমান রা: স্বীয় পিতা আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূল সা:-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে বেরিয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে আমরা একটি পাখি দেখলাম যার সাথে দুটো বাচ্চা ছিল। আমরা বাচ্চা দুটো ধরে ফেললাম। এতে পাখিটি তার ডানা বিস্তার করে বাচ্চাদের ওপর ঝাপটা মারতে লাগল। এর মধ্যে মহানবী সা: ফিরে এলেন এবং পাখিটির অস্থিরতা দেখে বললেন, বাচ্চাকে আটকিয়ে রেখে কে ওকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে? ওর বাচ্চা ওকে ফিরিয়ে দাও।’ এরপর রাসূল সা: একটি পিঁপড়ার ঘর দেখলেন যা আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঘরগুলো কে জ্বালিয়েছে? আমরা বললাম, ‘আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছি।’ তিনি বললেন, ‘আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়ার অধিকার একমাত্র আগুনের মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই।’ (আবু দাউদ) অন্যায়ভাবে যারা প্রাণী হত্যা করে মহানবী সা:-এর বাণীর প্রতি তাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার।

ইদানীং বিশ্বব্যাপী পাখিপ্রেমীদের কর্মকান্ড নিরীহ এ জীবটির প্রতি মানুষের অনুরাগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। পাখিদের প্রতি জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এদের বংশ বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে এদের হত্যা ও উত্ত্যক্তকারীদের যথাযথ শাস্তির বিধান কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!