• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
নিমতলী ট্র্যাজেডির ৬ বছর

কখনোই সরবে না রাসায়নিক গুদাম!


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৩, ২০১৬, ০৫:৩৭ পিএম
কখনোই সরবে না রাসায়নিক গুদাম!

পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরেনি। সামান্য অসতর্কতায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন সব পণ্যের বেচাকেনা চলছে সমানে। পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে মনে হয় না, ৬ বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৮ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন।

আজ ৩ জুন। ছয় বছর আগে এই দিনে পুরান ঢাকার ৪৩/১ নবাব কাটারায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। বাড়িটির নিচতলায় ফোম তৈরির উপকরণ টলুইন ডাই আইসো সায়ানাইড ও মিথাইল ক্লোরাইডের গুদাম ছিল। এখান থেকে যে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, তা মুহূর্তে বহু মানুষকে স্বজনহারা করেছিল। নিমতলীতে গিয়ে বেশ কিছু ব্যানার দেখা গেছে। প্রতিবছরের মতোই ৪৩/১ বাড়িটির উল্টো দিকে ফলের দোকানে কালো ঝান্ডা উড়িয়েছেন মামুন মিয়া। তাঁর সাত বছরের ছেলে বৈশাখ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।

সাবেক সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্থানীয় কাউন্সিলর, পঞ্চায়েতরা তাঁদের শোক জানিয়েছেন, যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বার্তা দিয়েছেন। স্মৃতিস্তম্ভ ধোয়ামোছা হয়েছে। সেখানে খোদাই করা আছে ‘আমরা সচেতন। আজ এবং আগামী প্রজন্মকে সচেতন করার লক্ষ্যে নিমতলী ট্র্যাজেডি নির্মিত। এটি সচেতনতার প্রতীক।’

আসলে ওই এলাকার বাসিন্দারা কতটা সচেতন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় বারবার এই প্রশ্নই মনে ঘুরপাক খায়। স্মৃতিস্তম্ভ লাগোয়া টিনের চালায় বসে কথা হচ্ছিল জয়নাল আবদীন নামের সত্তর বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই দিকে আর কেমিক্যাল নাই। কিন্তু আশপাশে থাকতে পারে। কেমিক্যালের ব্যবসা না করলে মানুষ কী করব। সইরা যাইতে বলে অন্য জায়গায়। সেইখানে মানুষ নাই?’ বৈশাখের বাবা মামুন মিয়া এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের দোকানপাট আছে কি না, জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আদি ঢাকাবাসী ফোরামের সদস্যসচিব জাভেদ জাহান বলেন, ‘এই এলাকায় পরিকল্পিত নগরায়ণ হয়নি। অনেকের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তারপরও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক এলাকা থেকে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার হয় এমন কারখানা সরিয়ে নেয়া দরকার।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দাহ্য বস্তু ও রাসায়নিক দ্রব্যের একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকা ধরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার সব প্রতিষ্ঠান আগের জায়গায় রয়ে গেছে, নতুন প্রতিষ্ঠানও হয়েছে। জুতা তৈরির উপকরণ, ডায়িং, প্রিন্টিং প্রেস, ইমিটেশনের গয়না তৈরিতে লাগে এমন সব রাসায়নিক দ্রব্য ও অ্যাসিড ব্যবহার হচ্ছে এখানে। আরমানিটোলার শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ওপর প্রায় শতভাগ ভবনের নিচে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম দেখা গেছে। উল্টো পাশেও একই অবস্থা। রীতিমতো সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে গুদামঘরের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এ জায়গায়। সর্বোচ্চ ৮ ফুট চওড়া রাস্তার দুই ধারেও সারি সারি দোকানপাট, সেখানে রাসায়নিক উপাদানের পাশাপাশি দাহ্য বস্তু যেমন রেক্সিন, ফোম, প্লাস্টিক, স্যানিটারি উপকরণ, কাঠ ও রাবার বিক্রি হচ্ছে। কথা হচ্ছিল স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলামের সঙ্গে। ১৫ বছর ধরে তিনি আরমানিটোলার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, বাড়ির নিচে গুদাম আছে। কিন্তু এখানে যেসব রাসায়নিক বিক্রি হয়, সেগুলো অত ক্ষতিকর না। আমরা তাই জানি।’

এই এলাকায় সহস্রাধিক রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা থাকলেও আবাসিক এলাকা থেকে এগুলো সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুধু বড় রাস্তার ওপর থাকা ভবনগুলোর নিচেই না, এমন এমন জায়গায় গুদাম যে আপনার ভেতরে ঢুকতেই ভয় লাগবে।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান আকন্দ জানান, ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুন লাগার পর থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আবাসিক এলাকায় নতুন করে কোনো কারখানাকে অগ্নিনিরাপত্তা সনদ দেয়নি, পুরোনো প্রতিষ্ঠানের সনদও নবায়ন করেনি। তবে গতকাল পর্যন্ত আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরানোর কোনো উদ্যোগের কথাও জানা যায়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. হাসিব প্রথম আলোকে জানান, তিনি পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। এই এলাকায় হাজার খানেক দোকান আছে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে অভিযানে আসতে দেখেননি।

জানা গেছে, নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হতো। বছর চারেক ধরে আর অভিযান হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবাসিক এলাকার বাইরে সরিয়ে নেয়ার যে সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সেই সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!