• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতিতে আক্রান্ত অসহায় শিশুদের ইউসেপ


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬, ০৩:১৮ পিএম
দুর্নীতিতে আক্রান্ত অসহায় শিশুদের ইউসেপ

বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, কর্মজীবী এবং বিপথগামীসহ অবহেলিত শিশুদের নিয়ে ইউসেপ বাংলাদেশ কাজ করে। মানবিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিসেপ খুবই প্রসিদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বরাদ্দকৃত জায়গা সেগুনবাগিচায় তাঁর নিজের বাসকৃত বাড়িতেই ১৯৭২ সালে নিউজল্যান্ডের একজন অধিবাসী জনাব এল. এ. চেইনীর উদ্যোগে ইউসেপ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাননেতা বঙ্গবন্ধুর সহায়তা এবং ইউসেপ বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। সেই ইউনিসেপ আজ দুর্নীতিতে জর্জরিত বলে অভিযোগ করেছেন স্কুলটির শিক্ষিকা মাকসুদা বেগম।

বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইউসেপ স্কুলের শিক্ষিকা মাকসুদা বেগম এই অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দীর্ঘ ৪১ বছর ইউসেপ নির্বিঘ্ন সুনামের সাথে পথ চলেছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ইউসেপ বাংলাদেশের ছায়াতলে এসে নিজেদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কিন্তু ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ইউসেপ বাংলাদেশ-এর বোর্ড অব গভর্নরস কোনো সুষ্ঠু নিয়ম না মেনে এক উচ্চাভিলাষী অসৎ ব্যক্তিকে বেতন এবং অন্যান্য ভাতাদিসহ মাসিক প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকার সুবিধা দিয়ে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন যা সম্পূর্ণ অবৈধ। কেননা সে সময়ে ইউসেপবান্ধব নির্বাহী পরিচালক, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আফতাব উদ্দিন আহম্মেদ (অব:) সাহেবের চাকরির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও কেবল জাকী হাসানকে নিয়োগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত দুইজন নির্বাহী পরিচালকের বেতনভাতাদি প্রদান করা হয়, যা ইউসেপ-এর ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।

তিনি আরো বলেন, ইউসেপ বাংলাদেশ-এর বোর্ড অব গভর্নরসও ছিলো অবৈধ, কারণ তাঁরা ২০১১ সাল থেকে নিয়মানুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মোট ৩টি বোর্ডের কোনো অনুমোদন না নিয়েই ইউসেপ বাংলাদেশ পরিচালনা করে আসছেন। এমন হাজারও দুর্নীতির উদাহরণ তুলে ধরার জন্যই আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন।

তিনি অভিযোগ করেন, ইউসেপ বাংলাদেশ-এ Credit for Self Employment (CSE) নামে একটি কম্পোনেন্ট ছিল যার বাজেট ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, অথচ জনাব জাকি হাসান এবং অবৈধ বোর্ড অব গভর্নরস-এর চেয়ারম্যান জনাব মতিন চৌধুরি এ কম্পোনেন্টকে লোকসান দেখিয়ে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং এ কম্পোনেন্টের ৩৩জন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেন। এমনকি ঈদের প্রাক্কালে তাঁদেরকে উৎসব ভাতাও প্রদান করা হয়নি। এছাড়াও কারিগরি শিক্ষার প্রিন্টিং ট্রেডটি বন্ধ করে দিয়ে এর জনবলকে চাকরিচ্যুত করেন। চাকরিচ্যুত জনবলের মধ্যে অনেকেই চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ প্রায় ২,০০০ কর্মী কর্মরত ছিল। কিন্তু জনাব জাকি হাসান যোগদান করার পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন অবৈধ কর্মকান্ডের কারনে প্রায় ৩০০ জন কর্মী চাকুরিচ্যুত হন এবং অনেকেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।

তিনি জানান, UCEP-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Underprivileged Children Educational Programs । অথচ বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে সুবিধাভোগী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইউসেপ বাংলাদেশ-এর ৪৩ বছরের মাদার একাউন্ট পরিবর্তন করে অন্য ব্যাংকে ট্রান্সফার করেন। যার বিনিময়ে ২.৫% লাভের টাকা তাঁর পকেটে যাচ্ছে।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গত ২ বছরে জনাব জাকী হাসান-এর কর্মকা- পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে, ইউসেপ বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্যই তাঁর আগমন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি আসলে বানাতে চাচ্ছেন সুবিধাভোগিদের প্রতিষ্ঠান। নিজেদের আত্বীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের অন্যায়ভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি ইউসেপকে কুক্ষিগত করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত।

তিনি জানান, জাকি হাসান নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদানের পরপর-ই পূর্বের নির্বাহী পরিচালক কর্তৃক ব্যবহৃত সচল গাড়ী পরিবর্তন করে প্রায় ৬০লক্ষ টাকা দিয়ে নতুন গাড়ী ক্রয় করেন। তাঁর কক্ষসংলগ্ন বাথরুমটি বিপুল পরিমান টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাথরুমে রূপান্তরিত করেন। যা প্রতিষ্ঠানের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।

দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদানে পরিচালিত ইউসেপ বাংলাদেশ-এ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বই-খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ, যাতায়াত ব্যবস্থা, আর্থিক অনুদান এবং বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্নধরনের সুযোগ-সুবিধা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখ পর্যন্ত বাজেটে উল্লেখ ছিল। কিন্তু জনাব জাকি হাসান ফান্ড ক্রাইসিস-এর কথা বলে ২০১৪ সালেই ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বৃত্তি দেয়া এবং বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেন। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ কমিয়ে দেয়াসহ বন্ধ করে দেন এবং যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে বিভিন্ন রুট বন্ধ করে দেন। যার ফলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা লেখাপড়া করতে যেয়ে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

জনাব জাকী হাসান ওয়ার্কসপ, মিটিং ও সেমিনারের নামে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যয়বহুল হোটেলে অবস্থান করেন এবং অনৈতিক আমোদফূর্তিতে মেতে থাকেন। তাঁর ভয়ে বেশির ভাগ কর্মী চুপ করে থাকেন আর যারা এসব ব্যাপারে কিছু বলতে গেছেন তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ইউসেপ-এর কোন কর্মীকে তাঁদের চাকরি নিয়ে দুঃচিন্তা করতে হয়নি। সব কর্মী তাঁদের শ্রম ও কর্মদক্ষতা দিয়ে ইউসেপ-কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জনাব জাকী হাসান যোগদান করার পর থেকেই ইউসেপ বাংলাদেশ-এর কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নেন। অথচ জনাব জাকি হাসানের পূর্বে নিয়োগকৃত নির্বাহী পরিচালকদের সময়ে অপরাধবিহীন কর্মী ছাঁটাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তিনি বলেন, জনাব জাকী হাসান এ্যনাউন্সমেন্ট-২ এর মাধ্যমে ইউসেপের দক্ষ কর্মীদের ৬০ বছরের চাকুরীর আয়ু শেষ করে দিয়েছেন। এত সব দূর্নীতি করার সাহস তিনি কোথা থেকে পেলেন? ইউসেপ বাংলাদেশে রয়েছে অনেক সম্পদ, যার বেনিফিশিয়ারীই হচ্ছে কেবল মাত্র সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা অন্য কেউ নয়। এ্যনাউন্সমেন্ট-২ এর ক্ষমতাবলে জাকী হাসান কর্মী ছাঁটাই ও অর্থহীন অফার লেটার নামে প্রতারনা করতে থাকেন। যার কারেণ ৩জন কর্মী হার্ট এ্যাটাক করে ১ জন মৃত্যু বরন করেন। আরও অনেক কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন।

দূর্নীতিবাজ জাকী হাসানের হটকারী সিদ্ধান্ত এবং হীন নীল নকশা চক্রান্ত বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আমি মহামান্য হাইকোর্ট-এ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে একটি রিটের আবেদন করি এবং মহামান্য হাইকোর্ট বিষয়টি আমলে নিয়ে ইউসেপ বাংলাদেশ বোর্ড অব গভর্নরস-কে টহষধভিঁষ বলে ঘোষণা দেন এবং Announcement-2-এর উপর স্টে-অর্ডার দেন। এছাড়াও মহামান্য হাইকোর্ট সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যান অধিদপ্তর এবং এনজিও বুরে্যর উপর রুল জারি করেন। এজন্য আমরা মহামান্য হাইকোর্টকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

কিন্তু চেয়ারম্যান জনাব মতিন চৌধুরী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তথা তথ্য গোপন করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত ৪ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে ২৮ দিনের একটি স্টে-অর্ডার নেন। যা সম্পূর্ণ রূপে নিয়ম বর্হিভূত। এই স্টে-অর্ডারের সুযোগ নিয়ে ইউসেপ ট্রানজিশন কমিটি ও Enroute এর মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন এবং Announcement-2 ও ইউসেপ ট্রানজিশন গাইডলাইন ২০১৫ কার্যকর করে তাদের ইচ্ছামত নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে থাকেন এবং অনেক কর্মীকে চাকুরিচ্যুত করেন যা আদালত অবমাননার শামিল।

আপনাদের নিকট বিনয়ের সাথে জানতে চাচ্ছি, এ কেমন অমানবিকতা? এ কেমন বিচার? মহামান্য সুপ্রিমকোর্টে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখ আলোচিত এ মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হয়। অথচ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখ থেকে দূর্নীতিবাজ জাকী হাসান ও পরিচালন পর্ষদ একের পর এক অন্যায় করে আসছে, যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। এ কেমন তাঁদের ব্যক্তিগত শাসন ব্যবস্থা? কর্মীদের অবস্থা বিবেচনা না করে, মহামান্য হাইকোর্ট এর স্টে-অর্ডারকে অমান্য করে সর্বপরি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের শুনানিকে অগ্রাহ্য করে তিনি আর যা কিছু করুন না কেন কিংবা আর কিছু হোন না কেন তিনি এবং তাঁর পরিচালনা পর্ষদ ইউসেপ বান্ধব নন। অভিভাবকের নামে আজ তাঁরা হয়েছেন অভিঘাতক।

তিনি বলেন, জনাব মতিন চৌধুরী এবং জনাব জাকী হাসান ইউসেপ বাংলাদেশ-এর টাকা অপচয় করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমান অর্থ ও পেশী শক্তির বিনিময়ে সবাইকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। আমরা বিশ্বাস করি প্রভাবশালী মহল যত শক্তিশালীই হন না কেন আইনের উর্দ্ধে কেউ নয়। তাই মহামান্য আদালতের দিকে আজ আমরা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই বাঙ্গালী জাতির জনক একজনই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি বঙ্গবন্ধুর আর্শিবাদপুষ্ট ইউসেপ বাংলাদেশের জনক একজনই, মি. এল. এ. চেইনি, অন্য কেউ নন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গঠনের। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নও তাই। ইউসেপ বাংলাদেশ এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাতে চাই দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইউসেপ ও বাংলাদেশ দুটি একই সূত্রে গাঁথা। তাই দূর্নীতিমুক্ত ইউসেপ গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি। পাশাপাশি এদেশের সুশিল সমাজ, মানবাধিকার কমিশন ও মানবাধিকার সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সু-দৃষ্টি কামনা করছি এবং সাংবাদিকদের ভাইদের মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির সুরক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!