• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারি কোনো সংস্থায়


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ৭, ২০১৬, ০২:২৪ পিএম
বিদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারি কোনো সংস্থায়

বিশেষ প্রতিনিধি

এদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। ফলে একদিকে যেমন এদেশে অবৈধভাবে থাকা বিদেশি নাগরিকদের ছড়াছড়ি, অন্যদিকে বৈধভাবে থাকা বিদেশিদের বিষয়েও হালনাগাদ সমন্বিত তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এদেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই। ফলে বিদেশিদের মধ্যে কবে কার ভিনসা শেষ হচ্ছে, কে কোথায় অবস্থান করছেন, কতদিন ধরে আছেন, কে কী করছেন তার কোনো মনিটরিং করারও ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় অনেকেরই ধারণা- বর্তমানে এদেশে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি হবে। পুলিশ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশি নাগরিকরা বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে শিল্প খাতে, ট্যুরিস্ট, শিক্ষা ও অনঅ্যারাইভালসহ বিভিন্ন ভিসায় বাংলাদেশে এসে থেকে গেছেন। যাদের বড় একটি অংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। আর তাদের বড় একটি অংশই দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আয়কর ফাঁকি দেয়াসহ চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ঝামেলা এড়াতে বছরের পর বছর তারা ভিসা নবায়ন করছেন না। অনেকে আবার জড়িয়ে পড়েছেন প্রতারণাসহ ভয়ংকর সব অপরাধে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো অবৈধভাবে বসবাসকারী ওসব বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সরকারের তেমন কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। এতে বিদেশি তারা নির্বিঘ্নে বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার আত্মরক্ষার জন্য স্থানীয় লোকজনকেও তাদের অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত করছেন।

সূত্র জানায়, অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিরা এদেশে নানামুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ বিদেশিদের দ্বারা সংঘটিত হলো এটিএম বুথ জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এ কাজের প্রধান হোতা থমাস পিটার একজন বিদেশি নাগরিক। বুথের টাকা ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে এদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করে সে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিও করছে। বর্তমানে ডিবির হাতে রিমান্ডে থাকা ওই অপরাধীর সাথে দেশি-বিদেশি একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। তাছাড়া গতবছরের শেষদিকে মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ঢাকা ও রংপুরে দু’জন বিদেশি নাগরিক খুন হন। রংপুরে খুন হওয়া জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির বাংলাদেশে অবস্থানের বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। অথচ তিনি দীর্ঘদিন থেকে ওই এলাকায় বসবাস করছিলেন। কিন্তু ওসব ঘটনার পরও বিদেশিদের অবস্থান চিহ্নিত করাসহ তাদের বিষয়ে সার্বিক তথ্য সংগ্রহে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। যার উদাহরণ ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত পিটার। তাকে গ্রেপ্তার করার আগ পর্যন্ত পুলিশ তার বিষয়ে কিছুই জানতো না। তবে বিলম্বে হলেও এখন  পুলিশের টনক নড়েছে। এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়। তারপর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপার এবং প্রতিটি মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে জরুরি বার্তা দেয়া হয়। তাতে বলা হয়- বিদেশি নাগরিকদের অবস্থান সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করে এক মাসের মধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাতে হবে।

সূত্র আরো জানায়, বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে শিল্প খাতে ৩ হাজার ৮০০ জন এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন। আর ইতঃপূর্বে গত নভেম্বরে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সারাদেশে বৈধভাবে ১১ হাজার ৯২৫ বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন। তবে সেখানে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিদের বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান ছিল না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়েও এর বেশি কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

এদিকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ট্যুরিস্ট ভিসা ছাড়া আরো দুটি মাধ্যমে বিদেশিরা এদেশে আসেন। তার মধ্যে বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে শিল্প ও সেবা খাতে বিভিন্ন দেশের নাগরিক বাংলাদেশে এসে থাকে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) ও নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এনজিও ব্যুরো) মাধ্যমেও বিপুলসংখ্যক বিদেশি এদেশে আসে। ওই দুটি মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ হয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। শুধুমাত্র ট্যুরিস্ট ভিসায় আসা বিদেশি নাগরিকদের মনিটরিং করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশন শাখা। বিদেশিদের ব্যাপারে সরকারের ভিন্ন ভিন্ন ডেস্ক পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করায় এবং সমন্বয় না থাকার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি নাগরিকদের সঠিক পরিসংখ্যান এবং তাদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ওয়ার্ক পারমিট কিংবা ভিসার মেয়াদ না থাকলেও বিদেশি নাগরিকদের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ার ব্যাপারে উচ্চপর্যায় থেকে তাদের ওপর তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। সে কারণে বিদেশিদের কাছে কাগজপত্র আছে কিনা সে বিষয়টি জানতেও ভয় পায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। হোটেলে অবস্থান কিংবা বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট জমা দেয়ার বিধান থাকলেও অধিকাংশ বিদেশি ওসব আইন মানেন না। ফলে বিদেশিরা এদেশে নির্বিঘেœ অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে। আর পুলিশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর কালেভদ্রে বিদেশিদের আটক করতে সক্ষম হয়। তাতে করে এ সারির বিদেশিদের উপস্থিতি যতো বাড়ছে বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ততোটা হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ যারা অবৈধভাবে বছরের পর বছর বসবাস করছেন তাদের মধ্যে প্রতারক, জঙ্গি, সন্ত্রাসী ছাড়াও বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণœকারী আরো বড় ধরনের নাশকতাকারী কেউ থাকতে পারেন। এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের বেপরোয়া চলাফেরার কারণেও মাঝেমধ্যে পুলিশকে বিপাকে পড়তে হয়। গভীর রাতে বেসামাল অবস্থায় গাড়ি কিংবা রিকশায় তারা রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। সারারাত ঘুরেফিরে ঘরে ফিরে সকালে। ওসব নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে গলদঘর্ম মহানগর পুলিশ। তাছাড়া তারা অনেক সময় অশালীন আচরণও করে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোতে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়ে না।

অন্যদিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসরত অন্তত ৭শ’ বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিদেন দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলে- ক্যামেরুন, ঘানা, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, ইথিওপিয়া, আলজেরিয়া, লাইবেরিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের ১৬টি দেশের নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধী চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বিদেশিদের মধ্যে বেশিরভাগই পর্যটন ভিসায় এদেশে এসে আর ফিরে যায়নি। তাদের বেশিরভাগেরই কোনো পাসপোর্ট নেই। তারা গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে বিদেশে লোক পাঠানো, বাংলাদেশে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার আশ্বাস ও চাকরির প্রলোভন দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে নানা প্রতারণা করছে। আবার অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। এসব অপরাধে ইতিপূর্বে বেশ কিছু বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তবে বেশ কয়েকটি দেশের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ না থাকায় তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরতও পাঠানো যাচ্ছে না। পাসপোর্ট না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আটকের পর তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, যেসব দেশের নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ নেই তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর আগেও বিভিন্ন অপরাধে বিদেশিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটিএম বুথে টাকা লুটের ঘটনায়ও বিদেশি নাগরিকের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এসব কারণে পুলিশকে বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতে বলা হয়েছে।

একই প্রসঙ্গে পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) ড. জাভেদ পাটোয়ারী বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, চীন, কোরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সময় ট্যুরিস্ট ভিসা, অনঅ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে আর ফেরত যায়নি। যাদের অনেকেই বাংলাদেশে চাকরি ও ব্যবসাসহ নানা পেশায় রয়েছে। কর ফাঁকি দিতে তারা ভিসার মেয়াদ নবায়ন করছে না। তাছাড়া ভারত ও মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধপথেও অনেকে বাংলাদেশে এসে অবস্থান করছে। ওসব বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো জনবল ইমিগ্রেশন শাখায় নেই। তারপরও অবৈধ ওসব বিদেশিদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, বিনিয়োগ বোর্ড কোনো বিদেশি নাগরিক বা ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে না। সেক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেই যাচাই-বাছাই শেষে এক বছরের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনগত বিষয়, বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক লেনদেন এবং এনবিআর ইনকাম ট্যাক্সের বিষয়টি দেখে। কারোর চুক্তি বা ভিসার মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে আবেদন করতে হয়। আবার নবায়ন না করতে চাইলেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানোর নিয়ম রয়েছে। তারপরেও কেউ যদি অধৈভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করেন সেটা দেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!