।। কাঁঠালশিশুটি নির্বিকার।।
শুধু মানুষহত্যার জন্যে কী ব্যস্ততা মানুষের! হ্যামিলনের বংশীবাদকেরা নিদ্রাহীন। তাদের বেলুনসদৃশ চোয়ালও এখন সংকল্পে অটল। বদলে দিতে হবে সব। সব। গৃহস্থ বাড়ির গর্ভ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কংক্রীটের বাংকার। শস্যক্ষেতে রোপিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল মাইন। শতভাগ শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কালাশনিকভ রাইফেল।
বিশাল এক কারখানাই বটে- সুশৃঙ্খল, স্বয়ংক্রিয় এবং শৈল্পিক! কোথাও কোনো খুঁত নেই। দম ফেলবার ফুরসত নেই কারো। গণমাধ্যমে অবিরাম রণবৃষ্টি ঝরাচ্ছে একদল চৌকস শব্দসৈনিক। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে সংহারসঙ্গীত। উত্তাল শরীরজুড়ে পার্বত্য নদীর মতো আশ্চর্য সঙ্গীত নিয়ে নারীও নিষ্প্রভ, নিথর। তার গর্ভে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের ভ্রুণ।
কিছুই অক্ষত নয়। আইফেল টাওয়ারের চূড়া ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে জাতিসংঘের সদর দপ্তর আর শেক্সপিয়রের রচনাসম্ভার। সমুদ্র মন্থন করে সুনামির মতো ধেয়ে আসছে দিগন্তবিস্তৃত এক কালোর কফিন।
কাঁঠালশিশুটি নির্বিকার। আপনমনেই তরতর করে বয়ে যাচ্ছে সে।
।। পঙ্গু পরিত্রাণ।।
কাঁটা তারে ঝুলন্ত যে ঝলমলে কিশোরীকে দেখছো সে আমি।
এই মাত্র যার বক্ষ এফোঁড়ওফোঁড় হলো ঘাতকের অদৃশ্য বুলেটে-
রুদ্ধবাক শীতলক্ষ্যা শোকে;- কাকেরা উৎসব করে যার ফুলে উঠা পেটে-
সেও অন্য কেউ নয়- আমারই হাড়-মাংসে তৃপ্ত হয় লোভের সুনামি।
এই যে ভবন ধসে পড়ে, লঞ্চ ডোবে, অগ্নিযজ্ঞে বলি হয় কত স্বপ্নসাধ-
অংকবিশারদ তুমি- সংখ্যা বোঝো- তার চেয়ে ভালো বোঝো বিত্ত-অর্থবিল!
কংক্রীটের নীচে চাপা পড়ে থাকা- জলে ভাসা- আগুনে পোড়া যে-আর্তনাদ
হিম হয়ে আছে হিমালয়ে- মেরুতে মেরুতে- আমি সেই জীবন্ত ফসিল।
স্তেপের স্তব্ধতা ফুঁড়ে এই যে সুদীর্ঘ উটের কাফেলা নিয়ত চলেছে ছুটে চীন
কান্দাহার-ব্যাবিলন-বসরা অবধি- তুমি যাকে ভালোবেসে সিল্করুট বলে ডাকো
সে তো আমারই রক্তরেখা;- বর্শার ফলায় বিদ্ধ যে-করোটি দিয়ে মানচিত্র আঁকো
সেও আমি। আমিই জোগান দেই স্বর্ণমুদ্রা, সিল্ক আর হেরেমের অন্ধকারে দিন।
চেঙ্গিজ খাঁদের অজেয় অশ্বের পদাঘাতে উড়ে যায় যত উলুখাগড়ার প্রাণ-
আমি সেই শবাধার। অদূরে নিভৃতে খুব পাথরে মস্তক ঠোকে পঙ্গু পরিত্রাণ!
।। তুমি শুধু পোড়ামাটি চেয়েছিলে।।
কোথায় না দেখেছি তোমাকে!
কত নামে কতবার নাজেল হয়েছো তুমি এই ধরাধামে।
পৃথিবীর পথে পথে পরিত্যক্ত খুলিতে খোদিত আছে সব কীর্তিগাথা।
খা-ব খেয়েছো তুমি; তোমার পোট্রেট
আঁকা আছে কুরুক্ষেত্রের বিশাল ক্যানভাসে। গোয়েরনিকায়
তোমাকেই এঁকেছেন পাবলো পিকাসো তার মহান তুলিতে।
মাই লর্ড, আর কত সাক্ষ্য চাও তুমি?
গ্যাসচেম্বারের বধির দেয়াল কি যথেষ্ট নয়?
কান পাতো কালিদহে, দজলা-ফোরাতে।
সপ্তডিঙ্গা ডুবিয়েছো- চাঁদগৃহে চরিয়েছো ঘুঘু।
ভিয়েতনামের নদী নারী আর নীলিমা যখন পুড়ছিল,
পাইলটের পাশের সিটে বসে তুমি হাসছিলে।
পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকার আকাশে শেষবার
তোমাকে দেখেছি; তুমি শুধু পোড়ামাটি চেয়েছিলে-
শুধু পোড়ামাটি! অপূর্ণ বাসনা নিয়ে তাই বুঝি
আবার এসেছো ফিরে এ-বাংলায়। কলার ভেলায় যার সমগ্র জীবন
তাকেই পোড়াতে চাও সামান্য আগুনে! বণিকের বহু আমি
কার সাধ্য নত করে অধমের অনত মস্তক!
যতই পোড়াও তুমি- চাপা দাও মাটি-
ছাইভস্মের ভেতর থেকে ফের জন্ম নেব আমি।
আপনার মতামত লিখুন :