• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকে ঋণ বিতরণের হার কমছে


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬, ০৪:২৪ পিএম
রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকে ঋণ বিতরণের হার কমছে

বিশেষ প্রতিনিধি

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা।ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাকে ঋণ বিতরণের হার অব্যাহতভাবে কমছে। তাছাড়া বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি মালিকানাধীন এই ব্যাংকগুলোতে ঋণে সুদের হার বেশি। অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে সার্ভিস চার্জও বেশি। শুধু তাই নয়, অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি।

অন্যদিকে একাধিক জালিয়াত চক্র এই ব্যাংকগুলোকে কব্জা করে রাখায় ঋণ নিতে গিয়ে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের চরমভাবে হয়রানিরও শিকার হতে হয়।

জানা গেছে, গ্রাহক হয়রানি ও উচ্চ সুদের ভয়ে নতুন কোনো উদ্যোক্তা রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে যাচ্ছেন না দীর্ঘদিন ধরে। পুরনো উদ্যোক্তারাও সরে আসছেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণের হার অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ক্রমাগত সরে আসার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত প্রায় এক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকে ঋণ বিতরণের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। প্রতিবেদন অনুযায়ি, ২০১৫ সালের মার্চ শেষে এই ব্যাংকগুলো মোট ঋণের ২০ শতাংশেরও বেশি পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছিল। এর তিন মাস পর জুনে ঋণ বিতরণ ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ৬ মাস পরে আরও কমে গিয়ে ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ডিসেম্বর প্রান্তিকেও এই ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণের হার কমেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ি, পরিমাণের দিক থেকেও ঋণ বিতরণ কমেছে এই ব্যাংকগুলোতে। ২০১৫ সালের জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। তিন মাস পরে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে ঋণ বিতরণের অংক দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। তিন মাসের (জুন-সেপ্টেম্বর) ব্যবধানে ঋণ বিতরণের হার কমেছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।

এদিকে সরকার বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিলেও ব্যাংক ঋণে সুদ হার বেশি হওয়ার কারণে তা সফল হচ্ছে না। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি হারে সুদ আদায় করছে। চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে এই ব্যাংকগুলো ১৪ শতাংশ সুদ হার নির্ধারণ করলেও বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংক এখন গড়ে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করছে।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর এক সাবেক সভাপতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা খুবই কঠিন। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। এ কারণে উদ্যোক্তাদের জন্য এই ঋণ এখন বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চ সুদের পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলো নানা ধরনের চার্জ নিচ্ছে। ব্যাংকের হিসাবের মারপ্যাঁচে চড়া সুদ গুণতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।’

কেবল উদ্যোক্তারাই নন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও মনে করেন, বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদ। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সুদের হার কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা ধরনের দুর্নীতির কারণে এই পাঁচ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। একইভাবে অব্যবস্থাপনার কারণেও খেলাপি আদায় কমে গেছে। এছাড়া বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে এই ৫ ব্যাংক। আবার এ ব্যাংকগুলোতে জালিয়াতির ঋণে সুদ মওকুফের ঘটনাও ঘটেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোতে ‘কস্ট অব ফান্ড’ বেড়ে গেছে। এসব অজুহাতে শিল্প ঋণে উচ্চ হারের সুদারোপ করছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তাদের।

অন্যদিকে উদ্যোক্তারা বলছেন, ঋণে সুদ হার সম্প্রতি কমলেও এর সঙ্গে নানা ধরনের সার্ভিস চার্জও নেয়া হচ্ছে। এর ফলে এই সব ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের উচ্চ হারের সুদ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, যেকোনো ব্যাংকে সুদের হার বেশি থাকলে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে যাবে না। আর ঋণ না নিলে বিনিয়োগও হবে না। এ কারণে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি প্রাপ্তির বিষয়টি সহজ করা জরুরি। বিশেষ করে সুদের হার কমানো জরুরি।’

এদিকে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও একাধিক জালিয়াত চক্র নাম সর্বস্ব বিভিন্ন কোম্পানির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই সব টাকার অধিকাংশই ব্যাংক আদায় করতে পারছে না। ফলে এই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অবশ্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এইসব জালিয়াত চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এরপরই আছে জনতা ব্যাংক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এসব ব্যাংকে মোট ঋণের ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশই খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা সাংবাদিকদের জানান, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সুদের হার বেশি হওয়ার পেছনে মূলত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়াই দায়ী। যে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সে ব্যাংকে সুদের হারও বেশি।’

তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়। এছাড়া খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ উদ্ধারে মামলা পরিচালনা করতে খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে খেলাপি ঋণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ভালো গ্রাহকের ওপর।’

জানা গেছে, এই ব্যাংকগুলোতে সেবা নিতে গিয়ে গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। এই হয়রানি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় অধিকাংশ গ্রাহক এই ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কোথাও নালিশ পর্যন্ত করে না। তবে সচেতন কিছু গ্রাহক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে করা অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে হয়রানির ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অভিযোগের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

সংখ্যানুপাতে একক ব্যাংক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ২৫৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে। তালিকায় ৩য়, ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ স্থানে রয়েছে যথক্রমে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রের (সিআইপিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৫ এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে প্রকাশিত শীর্ষ ১০ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাপ্তির হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি; যা মোট অভিযোগের ২৮.১৩ শতাংশ।

অভিযোগ রয়েছে, নামসর্বস্ব সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠানকে বেআইনিভাবে ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকগুলো। ভুয়া জামানতেও ঋণ দেওয়া হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান জামানত ছাড়াও ঋণ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়েও ঋণ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বেসরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ব্যাংকগুলোর ঋণের একটা বড় অংশ বিতরণ হয় জালিয়াতির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অসাধু কিছু কর্মকর্তাই দায়ী।

হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, মাদারটেক, মাদার স্পিনিংসহ বড় বড় ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে। আর এসব ঋণের কারণেই ব্যাংকগুলোতে সুদ হার কমছে না।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কিছু ক্ষেত্রে দক্ষতার অবনমন হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সময় ভুল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। এর ফলে আদায় করতে পারছে না। যার কারণে এই ব্যাংকগুলোতে সুদ হার কমছে না।’

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!