• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দর যত বিষাক্ত ফুল


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১, ২০১৬, ১০:২৪ এএম
সুন্দর যত বিষাক্ত ফুল

সোনালীনিউজ ডেস্ক:
কী সুন্দর ওই নীল ফুলটি! খবরদার, ভুলেও এতে হাত দেবেন না। এই ফুল দেখতে যতটা সুন্দর ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর! বিশ্বাস হচ্ছে না, তাহলে শুনুন, এরকম একটি নয়, অনেক জাতের চোখধাঁধানো বর্ণিল ফুল রয়েছে যা বিষে ভরপুর। এগুলোর সংস্পর্শে এলে যে কোনো প্রাণি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। এরকম কয়েকটি বিষাক্ত ফুল নিয়ে আয়োজন :

মঙ্কসহুড
২০১৪ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান যুক্তরাজ্যের এক মালি। তার মৃত্যুর রহস্য এখনো পুরোপুরি উদঘাটিত হয়নি। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে একটি বিষাক্ত ফুলের সংস্পর্শে আসার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছিল। ওটি ছিল অ্যাকোনিটাম জাতের গুল্ম যা মঙ্কসহুড বা সন্ন্যাসীর আচ্ছাদন নামেই বেশি পরিচিত। এর আরো বেশ কিছু বাহারি নাম রয়েছে যেমনঃ উলফস বেইন, লেপার্ডস বেইন, মাউস বেইন, ওমেন্স বেইন, ডেভিলস হেলমেট,  ব্লু রকেট ও কুইন অব পয়জন। বিশ্বের সবচাইতে বিষাক্ত উদ্ভিদ হচ্ছে এই অ্যাকোনিটাম। এর মোট আড়াইশ’ প্রজাতি রয়েছে।

এ গাছের শেকড় থেকে ফুল সবই বিষাক্ত। তবে শেকড়েই রয়েছে বেশি বিষ। এর সান্নিধ্যে গেলেই প্রাণিরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এর বিষ ছড়ায় ত্বকের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। আর কোনোভাবে এটি পেটে গেলে আর রক্ষা নেই। শুরু হবে বমি ও পাতলা পায়খানা।

এ ফুলগাছটি এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা নীল রংয়ের ফুলগুলো দেখতে অনেকটা হেলমেটের মত। এজন্যই এর নাম শয়তানের হেলমেট। পাহাড়ি অঞ্চলে এ গাছগুলো বেশি দেখা যায়।

ওয়াটার হেমলক
২০১০ সালে লন্ডনে প্রেমিকাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন লাখভির কাউর সিং। তিনি তার সাবেক প্রেমিকা লাখভিন্দর চিমাকে কোনো বন্দুক বা ছুরি দিয়ে খুন করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিষাক্ত ওয়াটার হেমলক । তিনি খাবারের সঙ্গে গাছের শিকড় রান্না করে চিমাকে খাইয়েছিলেন। এরপর থেকে তার নাম হয় ‘কারি কিলার’।

সে যাক, আমরা আসি বিষাক্ত হেমলকের কথায়। এর আরেক নাম ইন্ডিয়ান একোনাইট। হেমলক ফুল দেখতে অনেকটা সাদা বা সবুজ ছাতার মতো। ভারতে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে ও পশ্চিমবঙ্গে এর দেখা মেলে। তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতেই বেশি দেখা যায়। এই গাছ এক মিটার লম্বা ও আধা মিটার চওড়া হয়ে থাকে। সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। এর বিষ পেটে যাওয়ার ৪৫ মিনিট থেকে  এক ঘণ্টার মধ্যেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে পেটব্যথা ও বমি। সঙ্গে প্রচণ্ড কাঁপুনি। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে মরণ ডেকে আনবে এই সুন্দর ওয়াটার হেমলক ফুলটি। তবে সবচেয়ে বিষাক্ত অংশ হচ্ছে এ ফুলগাছটির শিকড়। ফুলটিতে সিকোটক্সিন নামে এক ধরণের বিষ থাকে, যা মারাত্মক হৃদরোগের কারণ হতে পারে।

বেলাডোনা
এর আর এক নাম ভয়াবহ রাতের ছায়া। যদিও পুরনো নাম অ্যাট্রোপা ( Atropa)। গ্রিক দেবী অ্যাট্রোপসের নামানুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। পরে এর নাম হয় বেলাডোনা যার অর্থ ‘সুন্দরী নারী’। মধ্যযুগে নারীদের চোখের মনি বড় ও আকর্ষণীয় করতে এই ফুলের রস আইড্রপ হিসেবে ব্যবহার করা হত। সেজন্য এর নাম সুন্দরী নারী। এই গাছ দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ঘণ্টার আকৃতির ফুলগুলো বেগুনি, লাল, সাদা, গোলাপি রংয়ের হয়ে থাকে।

সোলানাসিয়া (Solanaceae) গোত্রের এ উদ্ভিদটি ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া এবং কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়।  ফুলটিতে থাকা ট্রপেন অ্যালকলাইডিস নামে বিষের কারণে মাথাব্যথা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি ইত্যাদি সমস্যা হয়। রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় কেউ কেউ না বুঝে এ ফুলটি প্রসাধন সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করতেন।

বিষাক্ত হলেও সেই প্রাচীণকাল থেকেই ওষুধ ও প্রসাধনী সামগ্রিতে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধ্যযুগে শল্যচিকিৎসকরা রোগীদের অজ্ঞান করার সময় অ্যনেসথেটিক  হিসেবে এটি ব্যবহার করতেন। প্রাচীন রোমে বিষ হিসেবে এ ফুল ব্যবহার করা হত। রটনা রয়েছে রোমান সম্রাট অগাস্টাস ও তার স্ত্রী ক্লডিয়াসকে এই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।

অটাম ক্রোকাস
অটাম ক্রোকাসের আর এক নাম ন্যাকেড লেডি বা নগ্ন নারী। সাধারণতঃ শরৎকালেই এ ফুল ফোটে। গাছের পাতাগুলো মরে যাওয়ার বহুদিন পর সেখান থেকে এই ফুল ফোটে বলে এর নাম ‘ন্যাকড ওমেন’ বা ‘নগ্ন নারী’। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর দেখা মিলবে।

রূপসী এই ফুলের বিষে প্রথমে শুরু হয় কাঁপুনি। তারপর রক্তচাপ কমতে শুরু করে। অবশেষে হৃদস্পন্দন থেমে মৃত্যু। এ কারণেই চোখ ধাঁধানো বর্ণিল এ ফুলটি পরিচিত ‘রূপসী মৃত্যুফুল’ নামে। এ ফুলটির কিছু উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি হলেও ফুলটি খেলে তা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং এখন পর্যন্ত এ বিষের কোনো প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়নি। আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তি ও অটাম ক্রোকাসের বিষ পেটে যাওয়া ব্যক্তির লক্ষণগুলো একই।

রডোডেনড্রন
এই গাছের ১০২৪টি জাত রয়েছে। এটি এশিয়ার গাছ। তবে উত্তর আমেরিকার অ্যাপালাচিয়ান পর্বতাঞ্চলেও এর দেখা মিলবে। এটি নেপালের জাতীয় ফুল। শীতের শেষদিকে ফুল ফুটতে শুরু করে। গ্রীষ্মের শুরুতেও গাছ ভরে থাকে বর্ণিল ফুলে।

আকর্ষণীয় এ ফুলগুলো মধুতে ভরপুর হলেও এই ফুলগাছের পাতা কল্পনাতীত বিষাক্ত। এই গুল্ম জাতীয় গাছের পাতা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ পুড়ে যাবে, লালা ঝরতে আরম্ভ করবে। সঙ্গে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এবং চূড়ান্ত বিপর্যয় হিসেবে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়তে থাকবে। বিষের প্রভাব এতটাই তীব্র হবে, অতি শীঘ্রই হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে না পারলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।

অলিয়েন্ডার বা করবী
আমাদের অতি পরিচিত করবী ফুলটিও কিন্তু কম বিষাক্ত নয়। এর ইংরেজি নাম অলিয়েন্ডার। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফুলগাছ দেখা যায়। এর আদি নিবাস মরক্কোর প্রাচীন শহর ভলুবিলিসে। বিশ্বে নানা রঙ ও নানা আকারের অলিয়েন্ডার রয়েছে।

নীল করবী
করবী ফুলের পুরো গাছটাই মারাত্মক বিষাক্ত। এর একটিমাত্র পাতা খেলেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। দক্ষিণ ভারতের প্রচুর মানুষের আত্মহত্যার সঙ্গে এ ফুলটির নাম জড়িয়ে আছে।

ড্যাফোডিল
ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মজেছিলেন বসন্তের ফুল ড্যাফোডিলে। হলুদ রঙের টিউলিপ জাতের ফুলটি তার এতই পছন্দ হয়েছিল যে আস্ত একখানা কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন।

এর আর এক নাম নার্সিসাস। সুন্দর এ ফুলটির গোটা গাছটিই বিষে পূর্ণ। এটি পেটে গেলে প্রথমে ঝিমানি ভাব দেখা দেবে। সঙ্গে প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা, বমি ও পাতলা পায়খানা। বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা গেলেও এর উত্তর আমেরিকায় এটি বেশি দেখা যায়।
ছয় পাঁপড়ির এ ফুলটি সাধারণত হলুদ ও সাদা রঙের হয়ে থাকে। তবে কমলা বা গোলাপি ড্যাফোডিলও দেখা যায়। এই ফুল দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনে। এর সিবলি অংশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘ক্যামেলিয়া হাউস’।

বিচ অ্যাপল
অত্যন্ত নিরীহদর্শন একটি গাছ , আর তার কপালেই জুটল কিনা গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এর দেয়া ‘সবচাইতে বিপদজনক গাছ’ এর তকমা! এর আরেক নাম ম্যাঞ্চিনেল। মেক্সিকো উপসাগরের কাছে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এই বিষাক্ত গাছের দেখা মিলবে। এই গাছের শাখা প্রশাখা,  ফুল, পাতা এমনকি ফলে এক ধরণের বিষাক্ত রস নিঃসৃত হয়, যা কিনা ত্বক স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোসকার সৃষ্টি করে। চোখে লাগলে যে কেউ অন্ধও হয়ে যেতে পারেন। এমনকি বৃষ্টির দিনে এই গাছের নিচে আশ্রয় নেয়াও বারণ, কারণ বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এই রস শরীরে লেগে যেতে পারে।

বিচ অ্যাপল ফল
এর গোলাপি আর বেগুনি রংয়ের থোকা থোকা ফুলগুলো কিন্তু দারুণ। আপনার মন কাড়তে এর জুড়ি নেই। বিচ অ্যাপল বা ‘ডেথ অ্যাপল’ ফলটি খেতে খানিকটা মিষ্টি এবং এর সুঘ্রাণ ক্ষুধা উদ্রেক করে। তবে একটি ছোট্ট কামড় আপনার মুখগহবর থেকে শুরু করে পাকস্থলি পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিতে যথেষ্ট। এই গাছ এতই বিপদজনক যে একে জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না। কারণ গাছের কাঠ পুড়ে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় সেটাও অন্ধ করে দিতে পারে। এই গাছের একমাত্র ব্যবহার হল আসবাবপত্র তৈরিতে। এছাড়া ইতিহাস বলে, শিকারীরা একসময় এই গাছের রস বিষ হিসেবে তীরের ফলায় ব্যবহার করত।

ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বর্ণিল শোভা উপভোগ করতে যেয়ে অনেক পর্যটকই না জেনে এই উদ্ভিদের বিষে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সাবান পানি দিয়ে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে ফেলতে হবে। আর পুড়ে গেলে বেশি করে পানি ঢেলে দিতে হয়। ক্ষতস্থান ফুলে গেলে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ প্রযোজ্য।

ক্যাস্টর অয়েল
আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য হাউস অব লার্কিং ডেথ’ বইটির কথা মনে আছে তো! এই রহস্য উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছিল এক বাক্স বিষাক্ত চকলেটকে কেন্দ্র করে। যে বিষ দিয়ে বানানো হয়েছিল চকলেটগুলো তা ছিল ক্যাস্টর অয়েল। বাংলাদেশে এটি ভেন্নার তেল নামে পরিচিত। এটি সেবনে ধীরে ধীরে আপনি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বেন।
ক্যাস্টর অয়েল বীজের মনোহরী ব্রেসলেট

রূপচর্চাসহ নানা কাজে ক্যাস্টরঅয়েল ব্যবহারের চল রয়েছে। কিন্তু এটি একটি বিষাক্ত গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম রাইসিন। এক টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েলের বিজ গুড়ো করে খেলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এই বিষ পেটে গেলে বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হবে। তবে চিকিৎসার জন্য আপনি যথেষ্ট সময় পাবেন-কমপক্ষে এক সপ্তাহ।  অনেকটা মটর দানার মত দেখতে বীজগুলো খয়েরি ও টকটকে লাল। লাল রংয়ের সুদৃশ্য দানা দিয়ে ব্রেসলেট বা মালা তৈরি করা হয়।
এই বীজ থেকেই হয় তেল

ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ীর তেল বাংলাদেশ ও ভারতে সৌন্দর্য চর্চায় বিশেষ করে কেশ পরিচর্যায় ব্যবহৃত হতো। এমনকি ২০১১ সালেও এটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন দোকানে এই তেল পাওয়া যেত।

১৯৭৮ সালে বুলগেরিয়ার ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী জর্জি মারকভকে এই ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বিবিসিতে কর্মরত ওই সাংবাদিক ও লেখককে লন্ডনের এক বাসস্টেশনে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়।

সোনালীনিউজ/সুজন

Wordbridge School
Link copied!