• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হুমকির মুখে সুন্দরবন


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬, ০৬:৫৫ পিএম
হুমকির মুখে সুন্দরবন

বিশেষ প্রতিনিধি

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবাধে চলাচল করছে জাহাজ। বন বিভাগ মতে- প্রতিদিন বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদী দিয়ে গড়ে ৫০টি জাহাজ চলাচল করে। আর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল করায় একদিকে যেমন বন্যপ্রাণী চলাচল বিঘিœত হয়, অন্যদিকে রাতে নৌযান চলাচল করায় অবৈধ কর্মকাণ্ডেরও সুযোগ থেকে যায়। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদীর বিকল্প হিসেবে ১৪০ কোটি টাকা খরচ করে ঘষিয়াখালী খাল খনন করা হয়েছে। ওই পথ দিয়ে জাহাজ চলাচলও শুরু হয়েছে। কিন্তু তারপরও জাহাজের মালিকেরা সুন্দরবনকে রেহাই দিচ্ছেন না। বন বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়। তারপর থেকে ওই পথে ৩টি বড় জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতর সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে উদ্বেগের জন্ম দেয়। ওই দুর্ঘটনায় পূর্ব সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে তেল। অথচ সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ওই ঘটনায় বন বিভাগ ও জাতিসংঘ যৌথ সমীক্ষা করে বলেছিল, তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তারা বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধের সুপারিশ করে। কিন্তু পথটি বন্ধ হয়নি। বরং পরে ওই পথে একটি সার এবং একটি কয়লা ও ছাইবাহী জাহাজ ডোবার ঘটনা ঘটেছে।

সূত্র জানায়, জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনে ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ার ফলে গত এক বছরে ওই বনে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন ও ভোঁদড়ের প্রজনন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাছাড়া তেল ছড়িয়ে পড়ার পর সুন্দরবনে সাদা ঈগলের সংখ্যাও কমে যেতে দেখা গেছে। ফার্নেস তেলের মধ্যে যে কোনো প্রাণীর জন্যই ক্ষতিকারক মাত্রায় বিষাক্ত দ্রব্য থাকে উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই তেল বনের ঘাস, জলজ উদ্ভিদকণা, প্রাণী ও প্রাণীদের জীবনচক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে বন বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু হওয়ার পর বন্য প্রাণী শিকার ও পাচার বেড়ে গেছে। বন বিভাগের হিসাবে গত ১৬ বছরে চোরা শিকারিরা ৫২টি বাঘ হত্যা করেছে। তারমধ্যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু হওয়ার পর গত দু’বছরে শিকার হওয়া ১০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বন্য প্রাণী গবেষকদের আশঙ্কা- শিকার হওয়া বাঘের এই সংখ্যা আরো বেশি।

সূত্র আরো জানায়, ঘষিয়াখালী চ্যানেল এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। কারণ ১০ ফুট গভীরতার (ড্রাফট) জাহাজ ওই চ্যানেল দিয়ে চলাচল করতে হলে পূর্ণ জোয়ারের অপেক্ষা করতে হয়। আর পূর্ণ জোয়ার থাকে মাত্র দুই ঘণ্টা। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌযানের অধিকাংশই ১০ ফুট গভীরতার (ড্রাফট) বেশি। ফলে মংলা বন্দর থেকে সারাদেশে পণ্য পৌঁছাতে জাহাজ মালিকদের শেলা নদী ব্যবহার করতে হচ্ছে। যদিও মংলা-ঘষিয়াখালী খাল উন্মুক্ত করে দেয়ার পর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৩০টি জাহাজ ওই পথ দিয়ে চলাচল করেছে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল না করতে জাহাজমালিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও কোনো কোনো জাহাজ মালিক ওই নির্দেশ ভঙ্গ করছে। এখন নির্দেশ ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।

এদিকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধে বন বিভাগ থেকে একাধিকবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা কোস্টগার্ড পশ্চিমাঞ্চলের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানান- শেলা নদী বন্ধ করে শুধু মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে নৌযান চলাচল করবে এমন কোনো নির্দেশনা সরকারের কাছ থেকে কোস্টগার্ড পায়নি। তবে সরকারের আগের নির্দেশনা অনুযায়ী রাতে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল দল কার্গোর ফিটনেস, চালক নিজে নৌযান চালাচ্ছে কি না, অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করছে কি-না ওসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ জানান, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই জাহাজ চলাচল করতে দেয়া উচিত হচ্ছে না। এটা মারাত্মক ভুল কাজ হচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই শেলা নদী দিয়ে নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া।

এ ব্যাপারে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, বাঘ-হরিণ ও সাপের যেমন বাঁচতে হবে, তেমনি মানুষকেও বাঁচতে হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যেসব জাহাজ চলছে, সেগুলো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে। ফলে চাইলেই দ্রুত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান চলাচল একদম বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে মংলা-ঘষিয়াখালী খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। সামনে পর্যায়ক্রমে সব জাহাজ ঘষিয়াখালী খাল দিয়ে চলবে।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!