• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘দোস্ত... কোথাও হারিয়ে যাওয়া যায় না’


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ৪, ২০১৬, ০১:০০ পিএম
‘দোস্ত... কোথাও হারিয়ে যাওয়া যায় না’

সোনালীনিউজ রিপোর্ট

নুসরাত জাহান অরণী প্রতিদিন ভ্যানে করে রামপুরা থেকে বেইলি রোডে অবস্থিত ভিকারুননিসা নুন স্কুলে আসত। ক্লাসের ফাঁকে টিফিন খাওয়ার সময় হলে সবাই যখন হৈ-হুল্লোড় করে টিফিন খেত, সে সময় অরণীকে বিষণ্ন দেখা যেত। সে টিফিন বক্স নিয়ে ক্লাসের এক কোণে গিয়ে একা একা টিফিন খেত।

অন্য মেয়েরা একে অপরের টিফিন ভাগাভাগি করে খেত, আর অরণী ছিল দলছুট। আবার মাঝেমধ্যে একটু খেয়ে বাকিটা রেখে দিত। আর বাসা থেকে বের হয়ে যখন স্কুলের ভ্যানে ওঠার জন্য রাস্তায় আসত, ওই সময় অরণী থাকত একাই। অথচ অন্য মেয়েদের ভ্যানে তুলে দিতে আসত তাদের পরিবারের সদস্যরা। এমনকি গত ৬ মাসে একদিনের জন্যও অরণীর বাবা কিংবা মা তাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে আসেননি।

বৃহস্পতিবার অরণীর এক সহপাঠীর সঙ্গে কথা হয়। সে এসব কথা জানায়। এক পর্যায়ে ওই মেয়েটিও কেঁদে ফেলে। তবে সে নিজের নাম প্রকাশ করতে অনুরোধ জানায়। অরণীর সহপাঠী বলে, অরণী অনেক মেধাবী ছিল। তার সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীই পেরে উঠত না। অংকে এবং ইংরেজিতে অনেক দক্ষ ছিল সে। স্কুলের ম্যাডামরা সবাই তাকে অনেক স্নেহ করতেন। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আমি অরণীর সঙ্গে যাতায়াত করিনি। প্রতিদিন সকালে উঠেই অরণীর সঙ্গে ভ্যানে করে স্কুলে আসতাম। ছুটি হলে স্কুল থেকে সেই ভ্যানে করেই দুপুরের দিকে বাসায় ফিরতাম।

অরণীর ওই সতীর্থ জানায়, সে অরণীর কাছ থেকে জেনেছে যে, বাসায় ফিরে মায়ের খারাপ আচরণের কারণে ঘুমাতে পারত না অরণী। মা তাকে শুধু বকাঝকা করতেন। এজন্য সে মন খারাপ করে পড়ত। সেখানেই এক ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ত। বিকেল ৩টার দিকে গৃহশিক্ষক পড়াতে এলে আবার পড়তে বসত। একে একে দুজন গৃহশিক্ষক পর পর পড়াতেন। অরণী ও তার ভাই আলভী একই সঙ্গে পড়ত।

অরণীর ওই বান্ধবী কেঁদে বলে, ও ছিল আমার সেরা বান্ধবী। সবকিছু খুলে বলত তাকে। ওকে হারিয়ে আমিও দিশেহারা। গত জানুয়ারি মাসে একদিন স্কুলে এসে অরণী বলল, দোস্ত... কোথাও হারিয়ে যাওয়া যায় না। যাতে সেখান থেকে আর ফিরে আসা লাগে না। এমন কোনো জায়গা আছে। খুঁজে দেখ তো, পাওয়া যায় কি না।’ এসব বলতে বলতে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে অরণীর বান্ধবী। এর পরেও অরণীর বান্ধবী বলে,‘আঙ্কেল, অরণীর জন্য দোয়া করবেন। ও যেন ভালো থাকতে পারে।’

এদিকে আলভীর হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, মেইন ফটকের সামনে একটি কাগজে তার ছবি সম্বলিত শোকবার্তা টানানো হয়েছে। অনেকে সেটা দেখে আফসোস করেন। সাংবাদিক দেখে হাজির হয় আলভীর বন্ধু অনিক। সেও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।

প্রশ্ন করা হয় অনিককে- তুমি আলভীর সঙ্গে তার মাকে আসতে দেখেছিলে কোনোদিন? জবাবে অনিক বলে, ‘না, তার মাকে কোনোদিন ভ্যানের কাছে আসতে দেখিনি। এমনকি স্কুল থেকে নিতেও আসত না। একদিন দেখেছি, ভর্তির দিনে। এরপর আর কোনোদিন আলভীর মাকে স্কুলের আশপাশে কোথাও দেখিনি।’

অরণী-আলভীকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন না তাদের মা বেগম মাহফুজা মালেক। কোথায় তাহলে সময় কাটাতেন? এ ব্যাপারে জানতে অরণী-আলভীর গৃহশিক্ষক শামিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়।

শামিমা জানান, তিনি বিকেল ৩টার দিকে পড়ানোর জন্য রামপুরার ওই বাসায় যেতেন। অরণী নিজে দরজা খুলে দিত। মাঝেমধ্যে আলভীও দরজা খুলে দিত। তবে তার আগে দুজনই একটা মিষ্টি করে সালাম দিত। একদিন অরণী দরজা খুলতে না এলে তার মা তাকে প্রচণ্ড বকাঝকা করেন। আর পড়ানোর সময়ও তাদের মা কোনোদিন কাজে আসতেন না। কিন্তু অন্য জায়গায় পড়ানোর সময় মায়েরা তো সবসময় খোঁজ খবর নিতেন- কেমন পড়াচ্ছি? বাচ্চারা পড়ছে কি না, তা খোঁজ নিতেন। কিছুদিন হলো- অরণীর মা কেমন জানি আনমনা হয়ে থাকতেন। কেউ এলে (পুরুষ মানুষ) তাদের সঙ্গে অন্য ঘরে কথা বলতেন। অরণী ও আলভীর মৃত্যুতে শামিমাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) অরণী ও আলভীর মা বেগম মাহফুজা মালেক র‌্যাবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে যে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টায় তিনি (মা) নিজে দুই সন্তানকে হত্যা করেন। প্রথমে মেয়ে অরণীকে ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। মেয়েকে মারার সময় ছেলে আলভী ঘুমাচ্ছিল। এ অবস্থায় আলভীকে হত্যা করে। পরে বাসি চাইনিজ খাবার খেয়ে দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে বলে নাটক সাজান মাহফুজা। এমনকি দুই সন্তান যখন লাশকাটার ঘরে (ঢামেক মর্গ) নিথর অবস্থায় পড়ে আছে, তখন মা ও বাবা দুজনই জামালপুরে বাড়িতে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন।

চিকিৎসকরা প্রাথমিক অবস্থায় হত্যার আলামত পেলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে। একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে গোয়েন্দারা রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে। পুলিশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার থানায় মামলা করা হয়েছে।  রামপুরা থানার ওসি (তদন্ত) মুস্তাফিজুর রহমান জানান, দুই সন্তানের বাবা আমানুল্লাহ আমান নিজেই মামলাটি দায়ের করেছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!