• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অটিজম অভিশাপ নয়


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৩, ২০১৮, ১০:৫৭ পিএম
অটিজম অভিশাপ নয়

ঢাকা : অটিজম কোনো অভিশাপ নয়, নয় কোনো পাপের ফল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অটিজমকে অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার পর্যায়েও ধরা হয় না। অটিজম একটি স্নায়ুবিক উন্নয়নমূলক ব্যাধি। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার (এনডিডি)।  

অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার মতো অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে রোগের লক্ষণ সহজে ধরা পড়ে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। সাধারণত শিশুদের বয়স এক বছর হলেই এ লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে।  বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। তবে সরকারিভাবে সারা দেশে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ চিকিৎসা ও মানসিক উন্নয়নমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।  রাজধানীসহ সারা দেশে ১১টি অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ স্কুল আছে।

২০২১ সালের মধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আরো ১২০টি বিশেষ স্কুল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সঙ্গে সরকার অনুমোদিত ৬২ বিশেষ স্কুলের মাধ্যমেও সেবা দেওয়া হচ্ছে।  এখন পর্যন্ত অটিজমকে সামাজিকভাবে লজ্জা, সঙ্কোচ হিসেবেই দেখছেন আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকরা। সন্তানের এমন রোগ অনেকেই লুকানোর চেষ্টা করেন সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে। ফলে প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আক্রান্ত শিশুরা।

রাজধানীর ইস্কাটনে গড়ে উঠেছে অটিজম নিরাময় চিকিৎসাকেন্দ্র ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (আইএনডিআর)। সেবা কেন্দ্রটির সঙ্গে যোগাযোগ করে অটিজম আক্রান্ত বেশ কয়েকটি শিশুর খোঁজ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিশেষ সেবার মাধ্যমে ৯০ ভাগ সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে। এসব শিশুর অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চাননি। অবশেষে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছদ্মনামে একটি সরকারি সংস্থার উপপরিচালক বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে কথা বলেন।  তিনি তার শিশুকন্যা চৈতী (ছদ্ম নাম) অটিজম আক্রান্ত হওয়ার গল্প জানান।

তিনি বলেন, চৈতীর বয়স যখন তিন, তখন তার সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের থেকে তাকে আলাদা করা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু চৈতীর মধ্যে বিশেষ কিছু উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করল। উপসর্গগুলো বাবা-মায়ের কাছে ধরা পড়ল। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হন। জেনে আশাহত হন, চৈতির অটিজমের লক্ষণ রয়েছে। তারপর কিছু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতে ও ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে চৈতীর মা-বাবা ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চে (আইএনডিআর) যোগাযোগ করেন। প্রাথমিকভাবে আইএনডিআরের বিশেষজ্ঞ টিম চৈতীকে পর্যালোচনা করে দেখেন, তার কগনেটিভ স্কিল, পারসনাল কেয়ার স্কিল, প্রি-ভারবাল স্কিল তার সমবয়সী অন্য শিশুদের তুলনায় খুবই কম। এক কথায় তার স্বাভাবিক বিকাশ বিলম্বিত। ফলে তার মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছিল। পরে বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমে চৈতীর ছয় মাসের মধ্যে কাটতে শুরু করে। এখন চৈতী নিজের নাম বলতে পারে। নির্দেশনা দিলে তা অনুসরণ করতে পারে। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে পারে। আগে তা পারত না।  

চৈতীর এ উন্নতি দেখে তার মা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, চৈতী সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে থাকলে, সাধারণত বোঝা খুব কষ্টকর একসময় তার মেয়ে অটিজমে আক্রান্ত ছিল। চৈতীর মতো অনেকটাই সুস্থ জীবনে ফিরেছে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের ছেলে ফারহান ইসলাম। সে এখন ধানমন্ডির একটি বিশেষ স্কুলে ক্লাস ফোরের ছাত্র। নুরুল ইসলাম জানান, তার ছেলে বর্তমানে ফারহান ৯০ শতাংশই অটিজমমুক্ত। অটিজম নিরাময়ে ২০১০ সাল থেকে সরকারিভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এসব কার্যক্রম।

ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে মিরপুর, লালবাগ, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এবং রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর ও সিলেট এবং গাইবান্ধায় একটি করে ১১টি স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম চালু করা হয়েছে। এসব স্কুলের মাধ্যমে ১৪০ শিশুকে বিনামূল্যে বিশেষ থেরাপি সেবা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ৯২ কোটি টাকা অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলা সদরপর্যায়ে ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০টি অটিস্টিক স্কুল চালু ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ স্কুলগুলোর জন্য প্রমিত পাঠ্যক্রম ও একটি জাতীয় আইইপি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা সদর পর্যায়ে ২০টি অটিস্টিক স্কুল চালু এবং ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে অটিজম আক্রান্ত ১২০ জন বাবা-মাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা সদর পর্যায়ে ২০ অটিস্টিক স্কুল চালুর পরিকল্পনা এবং ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৬০ জন্য বাবা-মাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।  সরকারি স্কুলগুলোর বাইরে বেসরকারি ৬২টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলকে অনুমোদন দিয়ে সেগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন-ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে অটিজম রিসোর্স সেন্টার চালু করা হয়েছে।

এ সেন্টারের মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ থেকে ২০ বছরের ঊর্ধ্বে ৫ হাজার ৬৫২ জন অটিস্টিক রোগীকে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়েছে।  ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদা মিন আরা বলেন, অটিজম নিরাময়ে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পগুলোর বেশ কয়েকটি ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু চলমান রয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!