• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’


মোসাদ্দেক বিল্লাহ জানুয়ারি ২, ২০১৭, ১২:২১ পিএম
অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’

গেল বছর জঙ্গিবিরোধী আটটি সফল অভিযান চালিয়ে নজির সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অভিযানে জঙ্গি আস্তানা ও নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ‘নব্য জেএমবির’ শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীসহ নিহত হন ৩৫ জন ভয়ংকর জঙ্গি সদস্য। 

আর জঙ্গিদের পাল্টা হামলায় মারা যান চার পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২৫ জন। এত সফলতার পরও কালিমা লেপে আছে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনায়।

গেল বছর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১৯৬ জন; যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। 

ধারাবাহিক বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে এবার র‌্যাবের চেয়ে এগিয়ে গেছে পুলিশ। একসময় বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ‘আলোচিত’ ছিল র‌্যাব।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, আগের তুলনায় বন্দুকযুদ্ধ কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ২০১৫ সালে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৯২ জন। ২০১৪ সালে ১৫৪ জন। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রায় প্রতিদিনই বলে চলেছেন, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তারা সবাই অপরাধী। সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাবে, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। দেশে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অপরাধীদের মৃত্যুর কারণে দেশে শাস্তি ফিরেছে বলেও বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সূত্রমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে ১৯৬ জন নিহত হয়েছেন। 

সর্বশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে শরীফ নামে এক ব্যক্তি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পুলিশের দাবি, তিনি ডাকাতদলের সর্দার ছিলেন। আর গেল বছর পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতেই নিহত হয়েছেন ৩১ জন। তারা আগে থেকেই আটক ছিলেন।

আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, গত কয়েক বছরে কয়েকশ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত বলেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দিন দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত অপরাধীদের গ্রেফতারের পর বিচারের আওতায় আনা।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আনোয়র লতিফ খান বলেন, র‌্যাব তার অপারেশনের সময় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে গুলি চালায়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে ধরতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। তখন জীবন বাঁচাতে তাদেরও পাল্টা গুলি চালাতে হয়। গোলাগুলির একসময় সন্ত্রাসীরা নিহত হন। 

তিনি বলেন, আমরাও চাই অপরাধীদের ধরতে। তাদের বিচারের আওতায় আনতে। যারা নিহত হয়েছেন তারা সবাই বন্দুকযুদ্ধে হয়েছে।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ১৫ জন। পুলিশের ভাষ্য, নিহতদের বেশির ভাগই ডাকাত ও ছিনতাইয়ের সময় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। ৮ ডিসেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও ফরিদপুর সদরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চারজন নিহত হয়েছেন। 

৭ ডিসেম্বর সুন্দরবনে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই বনদস্যু নিহত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর দিনগত রাতে মেহেরপুরের গাংনীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিন যুবক নিহত হন। পুলিশের দাবি, নিহতরা চরমপন্থির সদস্য। 

এ ছাড়াও একই রাতে ধামরাইয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হানিফ আলী নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। যাকে পুলিশ ডাকাত ও ছিনতাইকারী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। ৫ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জের কলাবাড়ি এলাকায় ধানক্ষেত থেকে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনই ছিলেন নাটোরের যুবলীগকর্মী। 

স্থানীয় ও পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নেওয়া হয়। তবে পুলিশের দাবি, তিনজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ ঝামেলার কারণে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে ওই ঘটনার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। 

১ ডিসেম্বর রাজধানীর রামপুরায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন দুই যুবক। র‌্যাবের ভাষ্য, দুজনই ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্রের সদস্য। গত ২৪ নভেম্বর এক রাতে ফরিদপুরের মধুখালী ও পাবনার ঈশ্বরদীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত হন। নিহতরা ডাকাত বলে জানায় পুলিশ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১৯৬ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধ এবং ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে র‌্যাবের হাতে ৫৬ জন এবং পুলিশের হাতে ১০৮ জন নিহত হন। 

এ ছাড়া গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ১৩ জন, আনসার/রেল পুলিশের হাতে একজন, বিজিবির হাতে তিনজন নিহত হন। এর মধ্যে গ্রেফতারের আগে ১১৯ জন এবং নিরাপত্তা হেফাজতে ৩১ জন নিহত হন। এ ছাড়া গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন এবং গ্রেফতারের পর নির্যাতনের কারণে পাঁচজন নিহত হন। তবে 

এর আগে ২০১৪ সালে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৫৪ জন এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯২ জনে। আর গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৯৬ জন নিহত হয়েছেন। তাদের একটা বড় অংশই নিহত হয়েছেন নিরাপত্তা হেফাজতে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!