• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
এপির প্রতিবেদন

‘অনাকাঙ্খিত’ নবজাতকে রোহিঙ্গা মায়েদের লজ্জা ঘৃণা!


নিউজ ডেস্ক জুলাই ৭, ২০১৮, ০১:৫৪ পিএম
‘অনাকাঙ্খিত’ নবজাতকে রোহিঙ্গা মায়েদের লজ্জা ঘৃণা!

ঢাকা: রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় অনেক রোহিঙ্গা নারীই তাদের শরীরে বহন করে এনেছে ‘অনাকাঙ্খিত’ জীবনের সম্ভাবনা। সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া সেই নারীদের কেউ কেউ গর্ভপাত ঘটিয়ে রেহাই পেলেও অনেকেই গর্ভপাত ঘটাতে ক্লিনিকে যেতে পারেননি লোকলজ্জার ভয়ে।

কেউ ক্লিনিক পর্যন্ত গেলেও মৃত্যুভয়ে ফিরে এসেছেন শরণার্থী শিবিরে। তাদের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত নবজাতক। নিপীড়নের ভয়াবহ স্মৃতিচিহ্নের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে তারা পরিণত হচ্ছেন ঘৃণার পাত্রে। ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক শিশুকেই জন্ম দেওয়া হচ্ছে সবার অগোচরে।

মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি তাদের বৃহস্পতিবারের এক প্রতিবেদনে ওই নারীদের আতঙ্ক, ঘৃণা, উদ্বেগ, প্রশ্ন আর হতাশার কথা তুলে ধরেছেন। এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ধর্ষণের কারণে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীদের বেশির ভাগই কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আতঙ্কিত জীবন কাটাচ্ছেন। ধর্ষণের ভয়াবহ স্মৃতির সমান্তরালে রয়েছে সমাজবিচ্যুত হওয়ার ভয়।

ধর্ষণ ও জানাজানির ভয়ে ক্যাম্প থেকে বের হতে চাইছেন না সেই নারীরা। কেউ কেউ গর্ভাবস্থায় নিজেকে নিজেই সামলে নিচ্ছেন চিকিৎসাকেন্দ্রে আসার ভয়ে। যে সমাজে প্রায়ই ধর্ষণের শিকার নারীকেই রোষের শিকার হতে হয়, সেখানে সস্তা মূল্যের গর্ভপাতের পিল খেয়ে শুরুর দিকের অবস্থায় গর্ভপাত করিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন অনেকে।

কেউ কেউ আবার ‘অনাকাঙ্খিত’ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অনেকে আবার সদ্যজাত সন্তানকে দূরে ফেলে আসবে কি না, তা ভেবে সন্দিহান হয়ে পড়ছে। এপির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এক নারী লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিজে নিজেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বাইরে যেন শব্দ না যায়, তা নিশ্চিত করতে একটি কাপড় কামড়ে ছিলেন তিনি।

১৩ বছর বয়সেই ধর্ষণের শিকার হয় ‘অ’ (কল্পিত নাম)। পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে তিনি নিজের শরীরে অনুভব করেন আরেক শরীরের অস্তিত্ব। পরিস্থিতিকে ‘কারাগার’ তুল্য মনে হতে থাকে তার।

সমাজে ধর্ষিতার পরিচয়, বিয়ে বহির্ভূত সন্তান জন্মদান তার ভবিষ্যতকে দিশাহীন করবে, তাই গর্ভের সন্তানকে গোপন করার একান্ত চেষ্টা চালিয়ে যায় ‘অ’। গর্ভপাতের জন্য তাকে দ্রুত ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন তার মা। তবে চিকিৎসকরা সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যে বর্ণনা দিলেন তাতে ‘অ’ খুব ভয় পেয়ে গেলেন।

মনে হলো, গর্ভপাত করাতে গেলে তিনি মরে যাবেন। আর তাই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে গেলেন। প্লাস্টিকের দেয়ালে নির্মিত শরণার্থী শিবিরের ছোট্ট ঘরে সন্তানকে গোপন করা খুবই কঠিন, তবুও সেখানেই কয়েক মাস ধরে লুকিয়ে থাকল। কয়েক মিটার দূরত্বে থাকা টয়লেট ব্যবহার করা ছাড়া ঘর থেকে বের হতেন না।

সন্তানকে কোলে নিতেও অনীহা : সব হারানোর ভয়ে অনেক রোহিঙ্গা নারীই ধর্ষণের কথা গোপন করেন। সে কারণে কেউ জানে না, ধর্ষণের শিকার কতজন নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের ধাত্রী ড্যানিয়েলা ক্যাসিও বলেন, ‘মাতৃত্বকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে তারা সামনে আসে না। তারা গর্ভাবস্থার কথা লুকোতে চায়। আমি নিশ্চিত, গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের সময় অনেকে মারা গেছে।’

এপির সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে দেখেন ‘ম’ (কল্পিত নাম) একটি মাদুরের ওপর বসে আছেন। ধর্ষণের কারণে ভূমিষ্ঠ হওয়া তার শিশু সন্তানটিকে কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে আট বছরের বোন। বাচ্চাটিকে মায়ের কাছে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। তবে হাত তুলে ‘ম’ জানিয়ে দিলেন, তাকে কোলে নেবেন না। ‘আমি আর ওকে বয়ে বেড়াতে চাই না। আমি ওকে ভালোবাসি না।’

স্বামী উল্টো দায়ী করে চলে যান : এপিকে ‘এম’ তার সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা বলে যায়। গত বছরের আগস্টে তার গ্রামে আক্রমণ করে মিয়ানমারের সেনারা। ‘এম’ তাকিয়ে দেখেন, সেনারা ঘর-বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। দেখেন সেনা সদস্যরা তার প্রাণহীন দেহটাকে নিচে ফেলে দিল। পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করল। স্বামী ফিরে এসে তাকে নিতে বাড়িতে গেল এবং একসঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এলো তারা। এমের স্বামী তার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, সেনারা তাকে ধর্ষণ করেছে কি না, ‘এম’ তাকে কিছু বলতে পারেননি। শুধু জানিয়েছেন, সেনারা তাকে পিটিয়েছে।

আস্তে আস্তে ‘এম’ বুঝতে পারলেন শরীরে আরেকটি শরীর ধারণ করেছে। এক রাতে স্বামীকে জানালেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার ও গর্ভধারণ করার কথা। তার স্বামী তাকে সান্ত্বনা দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো তাকে দায়ী করে। তাকে ছেড়ে যেতে চান।

দুঃসহ স্মৃতির কথা বলেছেন : আরেক রোহিঙ্গা নারী ‘দ’ ধর্ষণের পর শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা নিয়ে কোনোরকমে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। একদিন জানতে পারেন, গর্ভবতী তিনি। স্বামীহারা বিধবা নারী যদি সন্তান জন্ম দেন, তবে সমাজে তার কী পরিণতি হবে- তা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।

ফার্মেসি থেকে গর্ভপাতের ওষুধ নিয়ে আসেন ‘দ’। গর্ভপাতের পর যেন তার মনে স্বস্তি ফিরে আসে। ‘দ’ বলেন, ‘আমার মনে হলো নতুন দুনিয়া ফিরে পেলাম। ওই বাচ্চার জন্ম দিতে হলে আমাকে বিষ খেয়ে মরতে হতো। কারণ আমার জন্য তা কলঙ্ক হতো। মানুষ আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলত।’

পোড়ে মায়ের মন : ‘অ’ জানান তার মেয়ে হওয়ার এক ঘণ্টা পরই এক সহায়তাকর্মীর কাছে তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্য কারো আশ্রয়ে আছে সে। ‘অ’ স্বপ্ন দেখেন একদিন কেউ না কেউ তাকে বিয়ে করবে, তার আরো সন্তান হবে। মাঝে মাঝে এক সহায়তাকর্মী বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে তার মেয়ের ছবি দেখিয়ে যান।

আর ‘অ’ স্বস্তি পান যেখানেই থাকুক, মেয়েটি ভালো আছে, নিরাপদ আছে। ‘অ’ বলেন, ‘বৌদ্ধদের কাছ থেকে এ সন্তান পেলেও তাকে আমি ভালোবাসি। কারণ তাকে আমি ৯ মাস ধরে গর্ভে ধারণ করেছি।’ মেয়েকে বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া ‘অ’-এর হাতে হয়তো কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এখনো পোড়ে মায়ের মন।


সোনালীনিউজ/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!