• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুমোদনহীন বইয়ে সিন্ডিকেটের জমজমাট বাণিজ্য!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২৭, ২০১৭, ০৮:৪০ পিএম
অনুমোদনহীন বইয়ে সিন্ডিকেটের জমজমাট বাণিজ্য!

ফাইল ফটো

ঢাকা: সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শিক্ষার্থীদের ‘সহায়ক’ হিসেবে অনুমোদনহীন বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কাজে যুক্ত আছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মাউশি, এনসিটিবির কয়েক কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক নেতা ও প্রকাশকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ওই সিন্ডিকেট।

প্রকাশকদের সঙ্গে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের বিনিময়ে চক্রটি মানহীন বই চাপিয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ। বাড়তি বই না পড়ার সরকারের নির্দেশ থোরাই কেয়ার করছে ওই সিন্ডিকেট। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সহায়ক বই বাণিজ্যের এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

অনুমোদনহীন বই পাঠ্যভুক্ত না করতে মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) ও এনসিটিবি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) বছরের শুরুতে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ বা নজরদারি করেনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় সেরেছে তারা।

শিক্ষার্থীদের অনুমোদনহীন বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে চড়া দামে। আনাড়ি লেখকের লেখা ও ভুলে ভরা এসব বই রাখা হয়েছে পাঠ্যভুক্ত। বইগুলো কিনতে হচ্ছে শিক্ষক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতাদের নির্ধারণ করা দামে।

অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বছরে কমপক্ষে ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকার অতিরিক্ত বই কিনতে হচ্ছে। অনুসন্ধানী সূত্রমতে, অনুমোদনহীন সহায়ক বই না পড়াতে এনসিটিবির নির্দেশ কাগজেই সীমাবদ্ধ। নির্দেশ না মানলে ‘শাস্তির’ কথা বলা হলেও চক্রের কারো বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই।

ঢাকার বাংলাবাজার, নীলক্ষেত ঘুরে দেখা যায়, ১০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১০ থেকে ১২টি সহায়ক বই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, বইগুলো ঢাকার অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কেনেন। চাহিদা অনুযায়ী সারা দেশের বিক্রেতা বাংলাবাজার থেকে বইগুলো পাইকারি দামে কিনে নেন।

কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে আলাপকালে অভিযোগ করেন, অননুমোদিত বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছেন শিক্ষকরা। এনসিটিবির করা জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যাকরণ বই নেই। অথচ ঢাকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অভিভাবকের হাতে সহায়ক ব্যাকরণের বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছে।

মাঠপর্যায়ে এনসিটিবির জোরালো তদারকি না থাকায় দেশজুড়ে চলছে অনুমোদনহীন বইয়ের জমজমাট বাণিজ্য। চাপিয়ে দেয়া বই পড়ানো হয় না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি বিদ্যালয় ও কলেজের কয়েকজন অভিভাবক সম্প্রতি অভিযোগ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম শ্রেণিতে বোর্ডের নির্ধারিত তিনটির বাইরে ১২টি বই পড়ানো হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরুল ইসলামের ‘ফাহাদ ইংলিশ গ্রামার অ্যান্ড ব্যাকরণ’, সামসুল হকের ‘ব্যাসিক এ-প্লাস ইংলিশ গ্রামার অ্যান্ড কম্পোজিশন’, হোসেন আলীর ‘ইজি পোটেনশিয়াল গ্রামার’, মোহাম্মদ আবদুল হাফিজের ‘শৈলী বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, গোলাম মোস্তফার ‘সেতু বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, নাজমা বানুর ‘ভাষা প্রদীপ বাংলা ব্যাকরণ’, মোসলেম উদ্দিনের ‘ফায়াদ বাংলা ব্যাকরণ’, রুহুল আমিন বাবলুর ‘অভিনব বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ আর মোস্তাফিজুর রহমানের ‘আমার সহজ বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বই পড়ানো হচ্ছে।

তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই সরকার থেকে বিনা মূল্যে পায়। ২০১৩ সাল থেকে সরকার বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বইও বিনা মূল্যে বিতরণ করে আসছে। এর পরও সহায়ক বইয়ের অবৈধ বাণিজ্য চলছে। কয়েকজন অভিভাবক বলেন, বাড়তি বইয়ের চাপ কোমলমতি শিশুদের বহন করতে হচ্ছে।

পাশাপাশি এসব বিষয়ে পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে খুদে শিক্ষার্থীদের। শিশুদের ওপর বাড়তি বইয়ের চাপ কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও মানে না ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, বগুড়াসহ প্রায় প্রতিটি বড় শহরের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, ‘শিক্ষার্থীরা জানার জন্য কিছু বাড়তি বই পড়তে পারে। তবে শিশুদের উপযোগী নয়, এমন বই দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে শিশুদের ওপর চাপ বাড়ছে।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অনুমোদনহীন বই পাঠ্য করার বিষয় নিয়ে কয়েক দিন আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বিদ্যালয়ে অনুমোদনহীন বই ‘বাধ্যতামূলক’ বিষয়ের মতো পড়ানোর চিত্র উঠে এসেছে। আটটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১০ থেকে ১২টি বই শিক্ষার্থীদের কিনতে শিক্ষকরা বাধ্য করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতক্ষীরা জেলার শিক্ষক সমিতির ১৪ জন নেতা ও কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অন্যদের যোগসাজশে এনসিটিবির অনুমোদনহীন বই পাঠ্যসূচি করেন। জেলার সাতটি উপজেলায় ৩১৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি বইয়ের তালিকা তৈরি ও দাম ঠিক করে। বই পাঠ্য করার বিনিময়ে শিক্ষকদের মাথাপিছু এক হাজার টাকা আর বিদ্যালয় প্রতি ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়।

আটটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের আটটি বই প্রায় পুরো জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- হাসান বুক ডিপো, জননী, জাকের, ফাহাদ বুক ডিপো, পরিচয়, টিউটর বুক ডিপো, স্বর, প্রকাশন ও হাসান বাজার প্রকাশনী।

যোগাযোগ করলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এনসিটিবির অনুমোদনের বাইরে কোনো বই পাঠ্য করা যাবে না। এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য মাউশিকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।’ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন ২৪ এপ্রিল থেকে বিদেশে থাকায় (৩ মে দেশে ফিরবেন) এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

অতিরিক্ত শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক) রুহী রহমান এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অনুমোদনহীন বই পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। কোথাও বিদ্যালয়ের কমিটির চাপে, আবার কোথাও শিক্ষকরাই কাজটি করছেন। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়ার জন্য আমরা অভিভাবকদের অনুরোধ করছি।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!