• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘অপরাজেয় বাংলা’ আছে, নেই ভাস্কর!


সাহিত্য-সংস্কৃতি ডেস্ক মে ২১, ২০১৭, ১০:৫৫ পিএম
‘অপরাজেয় বাংলা’ আছে, নেই ভাস্কর!

অপরাজেয় বাংলা (ইনসেটে নির্মাতা)

ঢাকা: ‘আমি এখানে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। অপরাজেয় বাংলা যত্নে থাকুক। এখানে ভাস্করের কোনো নামফলক নেই। আমি এখানে তার নামফলক স্থাপনের দাবি জানাই।

না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর অপরাজেয় বাংলার অনন্য নির্মাতা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের পরিবারের পক্ষে তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম এমন দাবি জানিয়েছেন।

শনিবার (২০ মে) দিনগত রাত পৌনে ১২টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন শিল্পকলায় (ভাস্কর্য) একুশে পদক পাওয়া গুণী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। রোববার (২১ মে) সকালে এই ভাস্করের অমর সৃষ্টি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।

সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানায়। এসময়ই উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ করে উম্মে কুলসুম অপরাজেয় বাংলায় ভাস্করের নামফলক স্থাপনের আহ্বান জানান।  

মৃত্যুকালে ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী উম্মে কুলসুমসহ দুই ছেলে ও এক  মেয়ে রেখে গেছেন। আব্দুল্লাহ খালিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক জানিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ২ মে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১০ মে থেকে সেখানে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ তার কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।

রোববার সকালে তার মরদেহ শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রীণ রোডের বাসভবনে। বাদ জাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে বিকেল ৩টায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

সকালে চারুকলা অনুষদের পর অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, মনিরুল ইসলাম, শহীদ কবির, ফকির আলমগীর ও মুহাম্মদ সামাদ। এছাড়া আরো শ্রদ্ধা জানানো হয় বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাবি শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ছাত্রলীগ, এশিয়াটিক সোসাইটি, উদীচী ও চারুশিল্পী সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। 

শ্রদ্ধা জানানোর সময় পরিবারের পক্ষে প্রয়াত ভাস্করের স্ত্রী উম্মে কুলসুম বলেন, আমি এখানে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। অপরাজেয় বাংলা যত্নে থাকুক। এখানে ভাস্করের কোনো নামফলক নেই। আমি এখানে তার নামফলক স্থাপনের দাবি জানাই।

সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতার পক্ষের সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি আমাদের পাশে ছিলেন। তিনি পোস্টার এঁকে সেগুলো মিছিলে নিয়ে আসতেন। তার গড়ে যাওয়া অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি এখনো আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের দেশে ভাস্কর্য শিল্পটি তুলনামূলকভাবে কম চর্চা হয়; সব ভাস্কর্যও শিল্পসম্মত নয়। সেখানে তিনি এ শিল্পকর্মের প্রতি অনুরক্ত থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

অনুজ এই শিল্পীর স্মৃতিচারণ করে মনিরুল বলেন, সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিল, তার স্ত্রী আমার ছাত্রী ছিলো। তার সঙ্গে আমার এমনই পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো। খালিদের ভেতরে একটা বারুদ ছিলো। সে প্রচুর কাজ করেছে। তার মধ্যে অপরাজেয় বাংলাটি সেরা। এর একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, অপরাজেয় বাংলা তার অমর সৃষ্টি, যা তাকে সারাজীবন জীবিত রাখবে। এ ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম সে পথে চলবে।

এর আগে সকাল ১১টায় তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সেখানে তার প্রতি চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও ছাত্ররা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক শেখ আফজাল, শিল্পী রফিকুন নবী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক সালেহ  চৌধুরী, নাট্যজন ম. হামিদ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭৩ সালে অপরাজেয় বাংলা নির্মাণকাজ শুরু করেন আবদুল্লাহ খালিদ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মৌলবাদীদের বিরোধিতার কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়। নির্মাণকাজ শেষে ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয় অপরাজেয় বাংলা। এরপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয় এই ভাস্কর্য। 

আব্দুল্লাহ খালিদ তার কর্মজীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৭২ সালে  সেখানকার লেকচারার থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর উদ্যোগে কলা ভবনের সামনে নির্মিতব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক অপরাজেয় বাংলার নির্মাণের দায়িত্ব পান। ১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৯ সালে ১৬ ডিসেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ করার পর স্থাপনাটির উদ্বোধন করা হয়। 

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে অবস্থিত মুরাল আবহমান বাংলা এবং ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান দপ্তরের সামনে অবস্থিত টেরাকোটার ভাস্কর্য নির্মাণ করেন আব্দুল্লাহ খালিদ। এছাড়া তাঁর আরো কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হল অঙ্কুর, অঙ্গীকার, ডলফিন, এবং মা ও শিশু। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত খালিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।

আব্দুল্লাহ খালিদ বাংলাদেশের সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চিত্রাঙ্কন বিষয়ে স্নাতক এবং পরে ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!