• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপেক্ষা শুধু ফাঁসির


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৮, ২০১৭, ০৪:০৮ পিএম
অপেক্ষা শুধু ফাঁসির

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার রায়টি নিঃসন্দেহে বিরল। নানা কারণেই ব্যতিক্রমীও বটে। এত দ্রুত ও একসঙ্গে এত আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন স্বস্তি এসেছে দেশে; তেমনি বিচার বিভাগের প্রতি আরেক দফা আস্থা এসেছে মানুষের। নিহতদের স্বজনরা কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছেন। 

বিচারহীনতার শঙ্কা কাটিয়ে দেশে বিচার বিভাগ যে স্বাধীন, এমন দাবিতে স্বস্তি এসেছে সরকারেও। এই প্রথম একটি রায়ে কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য করেনি কোনো মহল। এমনকি র‌্যাবের মতো একটি এলিট ফোর্সের ২৫ শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন সাজা হওয়ায় জননিরাপত্তা নিয়েও আশান্বিত সাধারণ মানুষ। এখন অপেক্ষা কেবল রায় কার্যকরের। অর্থাৎ দেশের মানুষ এখন অধির প্রতীক্ষা করছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নৃশংস ঘাতকদের মৃত্যুদন্ড দেখার।

সোমবার (১৬ জানুয়ারি) রায় ঘোষণার পর থেকেই মৃত্যুদন্ডাদেশ হওয়া ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকরের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের মানুষ। সভা-সেমিনারে, পথেঘাটে, আলাপচারিতায় ফাঁসি কার্যকরের দাবিতে মুখর বিভিন্ন অঙ্গন। নিহতদের স্বজনদের প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে খুনিদের ফাঁসি কার্যকর দেখতে চেয়েছেন। 

তারা এ রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ আবেদনও জানিয়েছেন। রায় কার্যকরে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও। যদিও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাজা মওকুফের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন; কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সরকার মনে করছে, উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে এবং খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে।

যদিও রায় কার্যকরে বিভিন্ন মহল আশান্বিত; কিন্তু সেই সঙ্গে আলোচনায় আসছে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত কি উচ্চ আদালতে রায়টি বহাল থাকবে, নাকি খালাস পেয়ে যাবেন আসামিরা, এমন প্রশ্ন যেমন উঠছে; তেমনি শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্ষমা ঘোষণা করেন কি না, সে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ। নাকি দীর্ঘসূত্রতার কারণেও কোনো জটিলতা দেখা দিতে পারে, আলোচনায় এসেছে এমন বিষয়ও।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যে দেশে এমন যুগান্তকারী রায় ঘোষণা হতে পারে, সে দেশে রায় কার্যকরেও নতুন দৃষ্টান্ত ঘটতে পারে। তবে একই সঙ্গে তারা রায় কার্যকর নিয়ে সম্ভাব্য কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছেন। 

তারা বলেছেন, দন্ডপ্রাপ্তরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও র‌্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। সুতরাং নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। 

তাছাড়া আইনগত দীর্ঘ প্রক্রিয়াও একটি বিষয়। সুতরাং সরকারকে এ রায় কার্যকর করতে হলে দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে ও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর এ রায় কার্যকর নির্ভর করছে বলেও মত দেন অনেকে।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, নিম্ন আদালতের দেওয়া ফাঁসির রায় কার্যকর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাইকোর্ট তা কনফার্ম (অনুমোদন) করেন। বিচারিক আদালতের রায় নথিসহ ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসবে। ডেথ রেফারেন্স হিসেবে আসার পর এ মামলার দ্রুত শুনানি শুরু করার চেষ্টা করা হবে।

এ ব্যাপারে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ শ ম রেজাউল করিম বলেন, যদি অন্য মামলার মতো এই মামলাও একই নিয়মে চলে তাহলে চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লেগে যাবে। মামলাটি সংবেদনশীল হওয়ায় দ্রুত নিরসন প্রয়োজন। এই আইনজ্ঞ বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর আপিল দায়েরের জন্য দুই মাস সময় পাবেন। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এ মামলার বিচার করা। কারণ সেখানে সরকারদলীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় লোকজন ছিল। র‌্যাবের মতো একটি সংস্থার লোকজনও ছিল। সেখানেই যখন সফল হয়েছে, তাই এখানেও সফল হবে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, দেশে ভয়ের সংস্কৃতি কাটিয়ে তুলতে এ রায় অগ্রগতি। বেআইনি নির্দেশনা ও বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, কেউ-ই যে আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় ও সাজা পেতে পারেন, এ রায় সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফাঁসি কার্যকর করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত সোমবার (১৬ জানুয়ারি) এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড এবং বাকি নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। 

সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।

ওই ঘটনা সে সময় পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়; হত্যাকান্ডে র‌্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়। নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও কান্নার শহর।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!