• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলায় শেষ ৪র্থ রোল বল বিশ্বকাপ


ক্রীড়া প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৭, ০৪:৫২ পিএম
অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলায় শেষ ৪র্থ রোল বল বিশ্বকাপ

ঢাকা: গেল ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্টনস্থ শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং স্টেডিয়ামে জমকালো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পর্দা উঠেছিল চতুর্থ রোল বল বিশ্বকাপের। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৪০টি দেশ এই বিশ্ব সেরার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনটি ভেন্যুতে সপ্তাহব্যাপী বিশ্ব সেরা হওয়ার লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে ২২ ফেব্রুয়ারি। পুরুষ ও নারী উভয় বিভাগে টানা তৃতীয় বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ভারত। যাকে বলে হ্যাটট্টিক শিরোপা জয়। দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই ক্রীড়াযজ্ঞের কিছু উল্লেযোগ্য ঘটনা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

নাচ গান আর মনোজ্ঞ ডিসপ্লের মধ্যে দিয়ে ৪র্থ রোল বল বিশ্বকাপের উদ্বোধন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন সামিনা চৌধুরী ও এস আই টুটুল। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দৃশ্যপট-টা পাল্টাতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। আসরের প্রথম দিনেই বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে আয়োজকদের ব্যর্থতা। বিকেল ৩টায় উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হবার কথা ছিল হংকং ও বাংলাদেশের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর, ম্যাচ আয়োজনে ভেন্যু প্রস্তুতিতে ফেডারেশনের উদাসীনতায় খেলা শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের তিন ঘণ্টা পর। পরে ম্যাচ সরিয়ে নেয়া হয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে। এছাড়া শুরুর দিনই মুল ভেন্যুতে দেখা যায় ক্ষত। তাড়াহুড়া করে নির্মিত এ কমপ্লেক্সের ফ্লোর খেলার উপযোগি ছিল না বিধায় হংকংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের উদ্বোধনী ম্যাচটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল আয়োজকরা। পরে জোড়াতালি দিয়ে এখানে কিছু ম্যাচ আয়োজন করা হলেও কমপ্লেক্সটি সেমিফাইনাল-ফাইনাল আয়োজন করার মতো নয়। যে কারণে বিশ্বকাপের টেকনিক্যাল কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলো মিরপুর ইনডোরে আয়োজন করতে বলেছে।

রোলবল বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পল্টন ময়দানে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স। এ বিশ্বকাপের মূল ভেন্যুও এটি। কিন্তু বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে নির্মিত সেই ভেন্যুই নাকি ফাইনালের উপযোগী নয়। যে কারণে প্রধান ভেন্যুটির পরিবর্তে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ফাইনাল সব খেলাই অনুষ্ঠিত হয় মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। টেকনিক্যাল কমিটি যে ফাইনাল ম্যাচটি শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সের পরিবর্তে মিরপুর ইনডোরে আয়োজন করতে বলেছে তা স্বীকারও করেছেন বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আসিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘টেকনিক্যাল কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা ফাইনাল মিরপুর ইনডোরে আয়োজন করছি।’

আক্ষেপের জায়গা আরো আছে। মাঠে প্রবেশের জন্য গণমাধ্যম কর্মী ও খেলোয়াড়দের যে পরিচয় পত্রটি দেয়া হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ নামের বানান দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠে সবার। প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা আবার অনেকের নামের বানান ভুল।

ফাইনালের দিনেও ঘটে নানা অঘটন। স্লেজিং করার দায়ে চড় খেতে হয় ইরানের খেলোয়াড় মোহাম্মদ রেজা শেখ জাফরিকে! বাংলাদেশের খেলোয়াড় হৃদয় পেনাল্টি থেকে গোল করে আঙুল উঁচিয়ে ইরানের গোলকিপারের দিকে বাজে অঙ্গভঙ্গি করেন। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি ইরানের খেলোয়াড় মোহাম্মদ রেজা শেখ জাফরি। ধেয়ে আসেন হৃদয়ের দিকে এবং তাঁকে ফেলে দেন কনুইয়ের গুঁতোয়। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন জাফরিকে। লাল কার্ড দেখা জাফরির দিকেই উত্তেজিত হয়ে ধেয়ে যান বাংলাদেশের ভারতীয় কোচ সুনীল ধাগে। বাদানুবাদের একপর্যায়ে চড় বসিয়ে দেন জাফরির গালে! পরে সংবাদ সম্মেলনে এসে অবশ্য জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা চান বাংলাদেশের কোচ। এরপর সংবাদ সম্মেলনকক্ষেই দুজন কোলাকুলি করেন।

একই দিন কেনিয়া-সেনেগাল ম্যাচে মারামারির ঘটনাও ঘটে। মেয়েদের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে কেনিয়া ও সেনেগালের ম্যাচ শেষে ঘটেছে এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তৃতীয় হওয়া কেনিয়ার খেলোয়াড় লুসি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলে সেনেগালের কোচ ও কয়েকজন খেলোয়াড় মিলে হেলমেট দিয়ে তাঁকে বেদম মারধর করেন। পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে। গুরুতর আহত অবস্থায় লুসিকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

হ্যান্ডবল-স্কেটিংয়ের শংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে রোলবল। শ্রী রাজু ধাবারে নামের এক ভারতীয় এই খেলাটির আবিষ্কারক। তিনি পেশায় একজন ক্রীড়া শিক্ষক। খেলাধুলা নিয়েই তার সার্বক্ষণিক পদচারণা। শৈশব থেকেই তিনি একজন ভালো স্কেটার। জাতীয় পর্যায়েও চ্যাম্পিয়ন তিনি। স্কেটিং চর্চা করতে গিয়েই তিনি মূলত নতুন এই খেলাটি আবিষ্কারের ধারণা লাভ করেন। প্রায় এক বছর এই ধারণা থেকেই নতুন খেলা আবিষ্কারে কাজ করতে থাকেন। সুন্দর একটি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এই বিষয়ে পড়ালেখা করতে থাকেন। একপর্যায়ে নিজস্ব ধারণা থেকেই রোলবল নামের একটি খেলা আবিষ্কার করেন ২০০৫ সালে। তবে এত সহজেই এত দূর আসা হয়নি খেলাটির। পুনের স্থানীয় লোকজন বাধা দিয়েছিল। জটিল পরিস্থিতিতে খেলাটি চালু করতে বাড়িও বন্ধক দিতে হয় রাজুকে।

রোলবল একটি দলীয় খেলা। যে কোনো ধরনের স্কেট পায়ে পড়ে খেলা যায়। প্রতি দলে খেলোয়াড় থাকে ১২ জন। মাঠে নামে ৬, রিজার্ভ ৬ জন। গোল স্কোরিংয়ে ফলাফল নির্ধারিত হয়। হ্যান্ডবলের মতো এক হাত অথবা দুই হাত দিয়েই খেলতে পারেন। এটি একটি ইনডোর গেমস এবং উডেন ফ্লোর বা যে কোনো শক্ত মেঝেতে খেলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের আইন অনুযায়ী কংক্রিট, টার্ফ, ম্যাট, উড বা আইস ফ্লোরে রোলবল খেলা হতে পারে। রোলবল খেলায় প্রধানত সরঞ্জাম- স্কেটস, হেলমেট, সেফটি গার্ড, গোলপোস্ট, বল।

২০০৫ সালে রোলবল একটি পূর্ণাঙ্গ খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ বছরই খেলাটির নিয়মকানুন নিয়ে বাংলাদেশে আসেন একজন ভারতীয় নাগরিক। ভারতীয়রা বাংলাদেশে খেলাটির প্রচলন করতে চাইলেও এখানে কোনো কোচ বা সংগঠক না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রসার পায়নি। ২০০৮ সালে আবারো ভারতীয়দের উৎসাহে ঢাকার উত্তরায় প্রথম রোলবল আয়োজন করে। ভারত ও বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে মূলত প্রশিক্ষণ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় এটি। ২০১০ সালে হংকংয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে ৮টি দেশ অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ সেখানে ১০ জন খেলোয়াড় নিয়ে অংশগ্রহণ করে বিস্ময়করভাবে ৩য় হওয়ার গৌরব অর্জন করে বলে অভিজ্ঞ স্কেটার আশরাফুল আলম মাসুম জানান। এছাড়া ২০১২ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত প্রথম ওয়ার্ল্ড কাপ রোলবলে অংশগ্রহণকারী ১৮টি দেশের মধ্যে ৭ম স্থান অধিকার করে বাংলাদেশ।

এবার ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত চতুর্থ রোলবল বিশ্বকাপে ফিজিকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছিল বাংলাদেশ। শুরু থেকেই দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে খেলে সেমিফাইনালে উঠেছিল স্বাগতিক পুরুষ দল। কিন্তু শেষ চারের লড়াইয়ে শক্তিশালী ভারতের কাছে হেরে বিদায় নেয় হৃদয়-সোহাগরা। স্থান নীর্ধারণী খেলায় নেপালের কাছে হেরে চতুর্থ হয় বাংলাদেশ। এটাই তাদের সর্বোচ্চ ফল। অপরদিকে হ্যাটট্টিক শিরোপা লাভ করেছে খেলাটির আবিষ্কারক ভারত। মাত্র একবারই কেবল শিরোপা হাত ছাড়া হয়েছে তাদের।

বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা আর উন্মাদনা নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হলো আরো একটি বিশ্বকাপ। নাম রোল বল। দেশের মানুষের কাছে খেলাটি অপরিচিত হলেও উদ্বোধনের পর থেকেই দর্শক বাড়তে থাকে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে ক্রীড়াঙ্গন। কিন্তু আয়োজকদের অসাবধানতায় শুরু থেকেই ‍বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে এত বড় একটি আয়োজনে সংগঠকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। দেশবাসী আশা করেছিল সফল আয়োজনের মাধ্যমে আবারোে এই ইভেন্ট আয়োজনের সুযোগ পাবে। কিন্তু অংশগ্রহণকারি দেশগুলোর খেলোয়াড় কর্মকর্তারা কী সন্তুষ্ট হয়ে দেশে ফিরছে? যতি তা না হয় তাহলে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআই

Wordbridge School
Link copied!