• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমানী কবি শহীদ কাদরী


ড. ফজলুল হক সৈকত আগস্ট ২৯, ২০১৬, ০৪:৩৭ পিএম
অভিমানী কবি শহীদ কাদরী

আধুনিক বাংলা কবিতার ‘জনপ্রিয়তা’র জোয়ার এবং নিরীক্ষাপর্বের কবি হিসেবে শহীদ কাদরী (জন্ম : ১৪ আগস্ট ১৯৪২; মৃত্যু: ২৮ আগস্ট ২০১৬) এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দেশভাগ-পরবর্তী কবিতার যে পালাবদল, যে অল্পকজন কবি এ ধারায় সৃজনশীলতার প্রমাণ রেখেছেন, শহীদ কাদরী সে ক্ষেত্রে অন্যতম কবি-প্রতিভা। ‘শহীদ কাদরীকে ভাবা হয় পঞ্চাশের সবচেয়ে মেধাবী কবি। তাঁর কবিতার তীক্ষ্ণ নাগরিকতা, নির্মেদ প্রকরণ এবং মনননির্ভরতা তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। 

প্রেক্ষাপট একই হওয়ায় এবং প্রকাশবঙ্গিতে সাদৃশ্য থাকায় কখনও কখনও শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীকে বিনিময়যোগ্য মনে হয়, কিন্তু তাঁদের কবিতার শরীরে সন্ধানী আলোক ফেললে বোঝা যায় দুজনের পার্থক্য। শামসুর রাহমান অন্তর্বৃত্ত ও আবেগী (তাঁর আবেগ যদিও অন্তঃসলিলা ও লাজুক), শহীদ কাদরী বহির্বৃত্ত ও মস্তিষ্কপ্রবণ।’ তাঁর কাব্যভাষা আমাদেরকে স্বতন্ত্র এক ভুবনের সন্ধান দেয় অনায়াসে। উজ্জ্বল বিশ্বনাগরিকতা-বোধ, নিবিড় স্বাদেশিকতা, শব্দ ও উপমা প্রয়োগে অভিনবত্ব তাঁর কবিতার সূত্রমুখ।

বাংলা কবিতা থেকে, বাংলার উদার-নির্মল মাটি থেকে শহীদ কাদরী এখন অনেক, অ-নে-ক দূরে অবস্থান করছেন। ‘...কবির একাকিত্বের যন্ত্রণা একান্তই কবির একার, কারণ, তিনি বিচ্ছিন্নতার দেয়াল-ঘেরা কারাগারে বন্দী, যন্ত্রণার অংশীদার নেই তাঁর।’ তাঁর এই অসহায়ত্ব ও একাকিত্বের ভয়াবহ চিত্র এঁকেছেন সমাজ, দেশকে নিয়েই। কাদরীর অভিব্যক্তি এরকম :

জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে-
সোনলি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগ্রে দিলো যেন
দীপহীন ল্যাম্প্পোস্টের নীচে, সন্ত্রস্ত শহরে
নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।
...        ...        ...
-এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা
এবং আমাকে নিষ্কপর্দক, নিষ্ক্রিয়, নঞর্থক
ক'রে রাখে; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা!
আর আমি শুধু আঁধার নিঃসঙ্গ ফ্লাটে রক্তাক্ত জবার মতো

বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীন চোখে
পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান কম্পাসের মতো
অনিদ্রায়।৫

(উত্তরাধিকার : উত্তরাধিকার) শহীদ কাদরীর কবিতার বিরাট একা অংশজুড়ে রয়েছে নাগরিক জীবনচিত্রের স্বরূপ-বাস্তবতা। ‘নাগররিক বৈদগ্ধে বিশুদ্ধ কবি শহীদ কাদরী।’ নগর, নগরের মানুষ, জীবনপ্রবাহ তাঁর শব্দবন্ধে প্রতিভাত বিচিত্রমাত্রায়। কিন্তু কিসের যেন তাঁর অতৃপ্তি, অপূর্ণতা। যাবতীয কোলাহলের ভিতরে থেকও যেন তিনি বড় নিঃসঙ্গ। ‘সমাজের সর্বত্র চোরাবালির উপস্থিতির অনুভব তাঁকে অবিশ্বাসী করে দিয়েছে। নিরবলম্ব কবি হয়েছেন নিরাশ্রয় ও নিঃসঙ্গ। কোনো শান্ত ঘরে, তাই, তার ডাক পড়ে না।’ যেন ভেসে চলেছেন বিপর্যস্ত নিঃসঙ্গতার দেহাত্মবাদের আরাধনায় :

এইক্ষণে আঁধার শহরে প্রভূ, বর্ষায়, বিদ্যুতে
নগ্নপায়ে ছেঁড়া পাৎলুনে একাকী
হাওয়ায় পালের মতো শার্টের ভেতরে
ঝকঝকে, সদ্য, নতুন নৌকোর মতো, একমাত্র আমি,
আমার নিঃসঙ্গে তথা বিপর্যস্ত রক্তেমাংসে
নূহের উদ্তাম রাগী গরগরে লাল আত্মা জ্বলে
কিন্তু সাড়া নেই জনপ্রাণীর অথচ
জলোচ্ছ্বাস নিঃশ্বাসের স্বর, বাতাসে চিৎকার
কোন আগ্রহে সম্পন্ন হয়ে, কোন শহরের দিকে
জলের আহ্লাদে আমি একা ভেসে যাবো?
(বৃষ্টি, বৃষ্টি : উত্তরাধিকার)

শহীদ কাদরীর কবিতায় চিত্রিত নাগরিকার যে প্রকাশ, বিশ শতকী নগর-মেজাজ, তা কালের প্রবাহে পরিবর্তিত হয়েছে। কাদরী সে গতিতে এগিয়ে চলেন নি। থেমে গেছেন। অনেকে মনে করেন তিনি অভিমানে কবিতা লেখা ছেড়েছেন। হয়তো তা সত্য। কিন্তু ভিন্নতর সত্য হলো নগর-মনস্কতার বাধ্যবাধকতা। নাগরিক কবি হওয়ার কতকগুলো সমস্যা থাকে। কাদরীরও আছে। নগরজীবনের রূপকারেরা নগর, শাহরিকতা থেকে বেশি দূর এগোতে পারেন না। হঠাৎ কোথায় যেন স্তিমিত হয়ে পড়েন। এমনটি হতে বাধ্য। আর তা ঘটে চার দেয়ালের মাঝে বাবনার ঘুরপাক খাবার তাড়নায়। শহীদ কাদরীর তিনটি কবিতা গ্রন্থেই নগর-মনষ্কতা প্রায় একই ধারায় প্রবাহিত। রয়েছে পুনরাবৃত্তিও। বাবের পুনরাবৃত্তি। এমন কি শব্দ-উপমারও। শেষের দিকে অনুভূতির প্রকাশও যেন অনেকটাই অতীব্রভাবে প্রক্ষেপিত।
    
একাত্তেরের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে, কী দিতে পেরেছে-এ প্রশ্ন সব সচেতন মানুষের চেতনার শেকড়ে নিবিষ্ট। এ সচেতনতা রাজনীতি-প্রেরণাজাত। শহীদ কাদরী দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই (তোমাকে অভিবাদন প্রিয়মতা, ১৯৭৪) অনেকটা রাজনীতি সচেতন হয়ে পড়েন। ‘সে কারণে তাঁর কবিতা অশিথিল থাকেনি, রাজনৈতি অনুচেতনায় বিস্তারিত হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে ব্যাপ্তি বাদ দিয়ে তিনি সমষ্টিকে অঙ্গীকার করেন। যদিও সমষ্টির তরল চিৎকার থেকে তিনি অনেক দূরে।’ ‘নিঃসঙ্গতাকে পরম সুহৃদ জেনে’ তাঁর পদযাত্রা। আর এই উপলব্ধি থেকেই ‘ঘোষিত হয়ে যায় কবির স্বাধীনতা-সংক্রান্ত তীব্র দ্যুতিময় পংক্তিমালা। প্রেম আর স্বাধীনতার ভেতরেও তিনি অজস্রবার গর্জমান ইস্পাতের অস্ত্রসমূহ লক্ষ করেন।’৯ শহীদ কাদরীর সে ভাবনার বর্হিপ্রকাশ এ রকম :

স্বাধীনতা, তুমি কাউেিক দিয়েছো সারাদিন
টো-টো কোম্পানীর উদ্দাম ম্যানেজারী করার সুবিধা 
কাউকে দিয়েছো ব্রারিকেডহীন দায়িতার ঘরে যাওয়ার রাস্তা
কাউকে দিলে অবাধ সম্পাদকীয় লেখার অপরূপ প্ররোচনা
উজ্জ্বল কিশোরকে ফের কবিতার আঁতুড় ঘর, মেঘের গহবর,
আর আমাকে ফিরিয়ে দিলে
মধ্যরাত পেরুনো মেঘলোকে ডোবা সকল রেস্তোঁরা
স্বাধনিতা, তোমার জরায়ু থেকে
জন্ম নিলেঅ নিঃসঙ্গ পার্কের বেঞ্চি,
দুপুরের জনকল্লোল
আর যখন-তখন এক চক্কর ঘুরে আসার
ব্যক্তিগত, ব্যথিত শহর, স্বাধীনতা!
(স্বাধীনতার শহর : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়মতা)

কাদরী শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন; পুঁজিবৃত্তির কাছে নয়। শহরের যান্ত্রিকতা আর সমূহ নেতিবাচকতার অন্তরালে তিনি খুঁজেছেন জীবনানন্দীয় কোমলতা, সুধীনীয় দৃঢ় সংবদ্ধতা, রিলকের শিল্পিত গোলাপ আর রাতের আকাশের জ্বলজ্বলে তারার অসীম উজ্জ্বলতা। শিল্পের, সৈৗকর্যের চর্চায়, পরিচর্যায় তিনি ছিলেন সর্বদা স্থিতধী :
অতএব কপর্দক-শূন্য আমি, কোনো পূণ্য নেই
আমার বিব্রত অস্তিত্বের কাছে
কেউ নয় ঋণী-এমন দারুণ কথা
কি করে যে বলি! যেদিকে তাকাই
াঁকে, পেভমেন্টে, আঁধারে, রাস্তায়
রেস্তোঁরায়, ছড়ানো ছিটানো
প্রোজ্জ্বল কবিতাগুলো চতুর্দিক থেকে উঠে এসে
দুটো নিরপরাধ নরম বই হয়ে ইতিমধ্যে
তোমাদের নোংরা আঙ্গুলির নীচে চলে গেলো,
এই কি যথেষ্ট নয়? এতেই কি লক্ষ লক্ষ টাকা
লেখা হলো না আমার নামে, পাওয়া হলো না
হে সময়, হে কার, হে শিল্প, হে বান্ধববৃন্দ,
টাকাগুলো কবে পাবো, কবে, কবে, কবে?
(টাকাগুলো কবে পাবো? : ওই)

কাদরীর কবিতায় প্রবল এক প্রত্যয়ের সন্ধান মেলে। নৈরাশ্যের অবগাহনে ভাসতে জানেন না তিনি। তিনি সামাজিক-ব্যক্তিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে অনুধাবন করেন বৈশ্বিক মননে। ‘শহীদ কাদরী বাংলা কবিতাকে যতটা বৈশ্বিক করেছেন, ...আমাদের, বাংরাদেশের, আর কোন কবি বোধ করি এতটা দাবিদার নন।’ জার্মানি, কানাডা, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সাহিত্যসভায় শহীদ কাদরীর কবিতা আলোচিত-নন্দিত। তাঁর কবিতা দেশ দেশীয কাব্যপ্রবাহ অতিক্রম করে বিশ্বমননের জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত আপন মহিমায়। তিনি লেখেন :
পরিত্যক্ত মূল্যবোধ, নতুন ফুলের কৌটোগুলো
জ্বলজ্বলে মনির মতন সংখ্যাহনি জ্যোৎস্না ভরে নিয়ে
নিঃশব্দে থাকবে ফুটে মধ্য-বিশ শতকের ক্লান্ত শিল্পের দিকে চেয়ে
-এইমতো নির্বোধ বিশ্বাস নিয়ে আমি
বসে আছি আজ রাত্রে বারান্দার হাতল-চেয়ারে
জ্যোৎস্নায় হাওয়ায়।
(নশ্বর জ্যোৎস্নায় : উত্তরাধিকার)

শহরের স্বাভাবিকতা কাদরীর কবিতার শরীর-কাঠামোর অনায়াস নির্মিতি। সমস্ত ক্লেদ, ক্লান্তি-অসুস্থতা, অস্বাভাবিকতার সৌন্দর্য তিনি তুলে আনেন অপার সৌকর্যে। অসুন্দরকে সুন্দর করার, অগ্রগ্রাহ্যকে অগ্রাহ্য করার যে শক্তি কবিতার-তা কাদরীর কাব্যভাষায় অস্তিত্ব-অন্বেষায় নিবিড়। তিনি রাত্রির শহরে অবমুক্ত অন্তর্বাস গণিকার অদ্ভুত অস্থির অলৌকিক আহবান শুনতে পান-স্যাঁতেস্যাঁতে ঠাণ্ডা উপসনালয়ে পেতে কান :
ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা
কানাকড়ির মূল্যে যা দিরে জীবনের ত্রিকূলে তা নেই
অচির মুহূর্তের ঘরে তোমরাই তো উজ্জ্বল ঘরনী
ভ্রাম্যমাণেরে ফিরিয়ে দিরে ঘরের আঘ্রাণ,
তোমাদের স্তব বৈ সকল মূল্যবোধ যেন ম্লান!
(আলোকিত গণিকাবৃন্দ : ওই)

রাজনীতি সচেতনতা শহীদ কাদরীর কবিতায় প্রোথিত। রাজনীতির নৈতিকতা তিনি বোঝেন। জানেন এর নোংরামির নির্মমতা। রাজবন্দী, মন্ত্রীর কালো গাড়ি, মিছিল, আহত মজুরের মুখ, ছত্রভঙ্গ জনতা, কাঁধে ক্যামেরা ঝোলানো সাংবাদিক, দেয়ালের পোস্টার, মাইক্রোফোন, সাঁজোয়া বাহিনী, কারফিউ, ১৪৪ ধারা-এসবই রানীতি, রাষ্ট্রনীতির কথকতা; মোড়ক-পোশাক। কল্যাণ-শান্তি আর তন্ত্র-মন্ত্রের পরিবর্তনের আশ্বাস সব-সব যেন ফাঁকা বুরি, শুন্য বাহবার বহর। তাঁর কবিতায় এ বোধ অত্যন্ত প্রখর :
রাষ্ট্র মানেই স্ট্রাইক, মহিলা বন্ধুর সঙ্গে
এনগেজমেন্ট বাতিল,
রাষ্ট্র মানেই পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত
ব্যর্থ সেমিনার
রাষ্ট্র মানেই নিহত সৈনিকের স্ত্রী
রাষ্ট্র মানেই ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া
রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা
রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই
লেফট রাইট, লেফট রাইট, লেফট-।
(রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়মতা)

আমরা-বাঙালি ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি চরম অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে-রাজনৈতিক অস্থিরতার গতর বেয়ে। শান্তি-স্বস্তি আমাদের কাছে সোনার হরিণ কিংবা চাঁদের অমাবস্যা হয়েই থেকে যায়। শাসকের হাত বদল-পক্ষান্তরে শোষকের হাতবদল, সেনাধ্যক্ষের শাসনভার গ্রহণ আর অসহায় জনতার নির্যাতিত হবার ইতিহাস আমাদের পরিচিত প্রসঙ্গ। এ দেশ-মা-মাটি একটু স্বস্তির জন্য, কাক্সিক্ষত সুবাতাসের জন্য আর্তচিৎকারে কাতর। আমরা-জনতা, অসহায় নির্বাক দর্শক মাত্র। কিন্তু এমনতরো অব্যবস্থা, অশুভ যাত্রা আর কতদিন চলতে পারে! একে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না। তা মহাবিপদজনক। কবি শহীদ কাদরী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর দুঃশাসন থেকে বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন আপন স্বপ্ন-বিভোরতায়। তিনি স্বদেশীয় সন্তানদেরকে, সহযাত্রীদেরকে, এমনকি অনাগত প্রজন্মকে উপহার দিতে চান অসংঘর্ষ-নিশ্চিত এক জীবন-ব্যবস্থা  :

ভয় নেই... আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হ’য়ে যাবে
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধী দলের অধিনায়ক হ’য়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছ-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
(তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়মতা)

শহীদ কাদরী আলোর উজ্জ্বল সভা-প্রত্যাশী। তাঁর অগ্রগমন অন্ধকারের বীভৎসতা থেকে নক্ষত্রের আলোর দিকে। তিনি ঐতিহ্য, গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বিচ্যুতি থেকে সরিয়ে নিজেকে- ব্যক্তিক অস্তিত্বকে সযত্নে সুন্দর রাখতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। কবিতায় তাঁর এ-অভিব্যক্তির প্রকাশ এরকম :
আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর হলেন এক
জাঁদরেল অফিসার;
তিনি স্বপ্নের ভেতর
টাকা নিয়ে লোফালুফি খেলতেন
টাকা নিয়ে,
আমি তাঁর ছেলে প্রথমে হলাম বেকার,
তারপর বেল্লিক
তারপর বেকুফ
এখন লিখি কবিতা
আমি স্বপ্নের ভেতর
নক্ষত্র নিয়ে লুফালুফি করি
নক্ষত্র নিয়ে;
(একটি উত্থান পতনের গল্প : কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই)

‘কাদরী যে-জীবনের জয়মিনার উত্থিত করে ধরেছেন, তা টিয়েপাখির পালক আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তৈরি এক নিশানের মতো, তা নির্বোধ নিরনুভব চীৎকারে পর্যবসান মানেনি, তিনি ধুলোমাটির পান্ডু সংসারের অভিজ্ঞা থেকেই তা তুলে ধরেছেন। এজন্যেই তা স্বাভাবিক, সুন্দরের জলে স্নাত সত্যের মূর্তির মতো প্রতিভাত হয়।’ শিল্পের উজ্জ্বল ক্যানভাসে জীবনকে, জগতকে আর প্রাপ্তির সমগ্রতাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন তিনি। কল্পনা নির্মিত-চেতনা নির্গত শব্দমালায়, কাব্যকথায় মানবসভার স্বভাব=স্বরূপ বিবেচনাধীন রাখতে চেয়েছেন। কবিতাকে কখনো তিনি ‘অক্ষম অস্ত্র’ মনে করেছেন; কখনো বা আবাহন জানিয়েছেন গর্জে ওঠার তাগিদে :

হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা
বিব্রত কাকের মতো
আমার ক্ষমতাহীন ডাইরির পাতার ভেতর বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে।
তাহলে তোমার ধ্যানে আবাল্য দুর্নাম কিনে আমি
অনর্থক বড়াই করেছি।
মধ্যরাত্রি পর্যন্ত অনিদ্রা এবং অস্থির জাগরণ ছাড়া তুমি কিছু নও,
কপালে দাও নি তুমি রাজার তিলক কিম্বা প্রজার প্রতিশ্রুতি 
তবে কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি তোমার পদমূলে!

বরং এসো করমর্দন ক'রে যে যার পথের দিকে যাই,
তবু আরো একবার বলি :
যদি পারো গর্জে ওঠো ফীল্ডগানের মতো অন্তত একবার...।
(কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা)

শহীদ কাদরী যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন চারদিকে ‘স্বপ্নের অভ্যন্তরে কবিদের নিঃসঙ্গ করুণ’ চিৎকার। সবখানে শুধু ‘গোলাপ! গোলাপ!’ আর্তনাদ। প্রেম-পাগল ক্ষীণকায় যুবক, নীলিমা, নিসর্গ, নারী-সবাই যেন আপন আপন ভুবন থেকে বিচ্যুত-স্খলিত। ‘জাঁদরেল নপুসংক’-এর ‘সুতী² চুম্বনে’ সবকিছু গোধুলির রাঙা হ্রদে বিলীয়মান। সভ্যতার গাঁয়ে ক্রমাগত জমাট বাঁধতে থাকে এক দৃঢ় কালশিরা। এই প্রতিবেশে কবি কখনো কখনো ‘নিজের মনুষ্যজন্মের’ জন্য মনস্তাপ ভুলে যান বেমালুম :
মনে হয় : যে লোকটা রোজ দুধ নিয়ে আসে
তার তোবড়ানো গালে একটা চুম্বন এঁকে দিই,
যে-কোনোদিনও কবিতা লিখবে না তাকেই ‘কবি সম্রাট’ আখ্যা দিই,
বন্ধুর ব্যাক জাকেটে
শিউলি ফুলের মতো ছড়িয়ে দিই
কিচু সোনলি মিথ্যে,
যুদ্ধ, হত্যা, মারী মড়ক, টুথব্রাশ, মাজন-এরা সব
জীবনের জটিল কল্লোল হ’য়ে ওঠে,
মলত্যাগ, মূত্রত্যাগের মতো অকথ্য, উচ্চারণের অযোগ্য ব্যপারগুলো
জয়গানের মতো মনে হয়।
(কোনো কোনো সকাল বেলায় : কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই)

মানুষ, মানুষের জীবন প্রণালীর চেয়ে কখনো কখনো মাছ-পাখিদের এবং তাদের জীবনকে বেশি পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় মনে হয়েছে শহীদ কাদরীর কাছে। তিনি মাছেদের, পাখিদের জীবন প্রবাহ সম্পর্কে ানবহিত থাকলেও নির্দ্বিধায় নির্বিকার আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন। কটি দৃষ্টান্ত :

ক. যতক্ষণ জলের ভেতর থাকে মাছগুলো
বাস্তুর অভাব তারা টের কখনো পায় না-
মনে রেখো, কখনো পাবে না।
(মৎস্য-বিষয়ক : কোথাও কোনো ক্লন্দন নেই)

খ. কিন্তু মৎস্যকুলে জলের রয়েছে অদ্বিতীয়
সম্মান। এবং মাছেরা জলেই বাস করে।
(বালকেরা জানে শুধু : ওই)

গ. ইদানীং আমার সমস্ত আস্থা পাখিদের স্বাস্থ্যের ওপর,
শালিক, চড় ই কিম্বা কাক ছাড়া কারো চোখ বিশ্বাস করি না,
পাখিদের সন্ত্রস্ত চীৎকার ব্যতিরেকে শুভাকাঙ্খী কাউকে দেখি না,
সারাক্ষণ এভিন্যুর প্রত্যেকটি বাঁকে কেবল ওরাই থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে
হোটেল, রেস্তোঁরা কিম্বা ব্যাঙ্ক অথবা টেলিগ্রাফের তারে, ছাদে
জানালায়, শার্সিতে, বারান্দায়, বুলেভারে রাস্তায় অথবা ফুটপাতে
অপেক্ষমাণ ডাক্তার অথবা দ্রুতগতি, শীতল নার্সের মতো নিরন্তর
কেবলই পাখিরা থাকে, লাফিয়ে-লাফিয়ে হাঁটে, ওড়ে কিম্বা বসে।
(পাখিরা সিগন্যাল দেয় : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা)

মানব-সভ্যতা এক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে চলমান। সুস্থির সময় যেমন নেই, তেমনি মানুষ, মানুষের প্রবণতা-গতিও কখনো সুস্থির ছিলো না, নেইও। আমরা-মানুষ চিকিৎসাতীত অজানা অসুখে আক্রান্ত; আজন্ম অসুখ আমাদের। স্বস্তি, স্বাস্থ্য কিংবা সৌন্দর্য অধরা-অলভ্য-মরীচিকাসম। কবিতা-পাগল মানুষ, একাকী মানুষ, পাগলা-গারদ, শুন্যের ভেতর মোম-কুপি, তীব্র কথা, বুড়ো পৃথিবী, পুরনো পুকুর, উজ্জ্বল সমকামী, দারুণ সবুজ সব-সবাই কল্যাণ-কণ্ঠে এঁদোকুয়োর ভেতর পুরুষ-বেশ্যার অফুরন্ত, অশেষ অভাব-অনুভবে নিমজ্জিত। শহীদ কাদরীর চোখে অসুস্থ অশান্ত-অস্নিগ্ধ পৃথিবী :
‘এই ঝোড়ো যুগে, অশান্ত হাওয়ায়’-কেউ বলে ‘একমাত্র
তুমিই ব্যতিক্রম, উদ্ধত স্বাস্থ্যের অধিকারী, একাকী, অটুট
আমি বলি : ‘এই স্বাস্থ্য আমার, এবং এর ধার, ঠিক সেই
ডাক্তারের মতো নিজের ব্যাধিগ্রস্ত আত্মীয়ের সুচিকিৎসা জানা নেই যার।’
(মানুষ, মানুষ : কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই)

এই বাংলার মাটি-আমাদের আবাসভূমি-শহীদ কাদরীর স্বদেশ শত অজানা বণিক-শাসকের চাপে বিপর্যস্ত আর অগণন বিদ্রোহের আগুনের শক্তভূমি। কাতার-কাতার অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনির অন্তরালে এই দেশ-মাটি অবিচল, অটুট, অনন্ত। বারবার সারাদেশ হয়েছে বধ্যভূমি। আর্তনাদে বহুবার প্লাবিত হয়েছে বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তর। স্বজন হারানোর ব্যথায কাতর, জীবনের আনন্দে ফিরে আসার ব্যাকুল প্ররোচনায় আমরা বিভ্রান্ত; পচা রক্তমাংসের ঘ্রাণে বিব্রত এ জাতি। অত্যাচার, মোহ, অচেনা শহরের বাতি, ইতঃস্তত হাঁটাহাঁটি, বিদেশের ফুটপাত, দোকানের বৈভব-সবকিছু থেকে দূরে সরে আমরা ফিরছি- ঘরমুকো আমরা; চেতনামুকো। ‘সকল বেদনা, গ্লানি, পরাভব, বিচ্ছিন্নতা, বিপন্নতা ও মৃত্যুর ওপারে জায়মান কবির প্রগাঢ় জীবনপ্রেম। নিঃসন্দেহে শহীদ কাদরী নির্মাণ করেছেন কবিতার এক নতুন উত্তরাধিকার।’ শহীদ কাদরী অনুভব করেছেন- এসব সত্যের আড়ালে নির্বিকারে ধীর পায়ে নিজস্ব উঠোনের পূর্ণিশার আলোয়, নিজেদের ঘরে ফিরছি আমরা-ফিরছি বিদন্তে জ্বেলে দিয়ে বিদ্রোহী পূর্ণিমা :
যদিও আজীবন আমি অচেনা ঝোড়ো সমুদ্রে
নীল পোষাক পরা নাবিক হ’তে চেয়ে
আপাদমস্তক মুড়ে শার্ট-পাৎলুনে
দিনের পর দিন
ঘুরেছি পরিচিত শহরের আশপাশে,
স্বদেশের বিহবল জনস্রোতে
অথচ নিশ্চিত জানি
আমার আবাল্য-চেনা ভূগোলের পরপারে
অন্য সব সমৃদ্ধতর শহর রয়েছে
রয়েছে অজানা লাবণ্যভরা তৃণের বিস্তার
উপত্যকার উজ্জ্বল আভাস,
(একুশের স্বীকারোক্তি : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা)

বাংলার জল-মাটি-বাতাস-আলো-প্রকৃতিতে শহীদ কাদরীর গতায়াত। তিনি অভ্যাগত কিংবা প্রত্যাগত নাগরিক নন। এদেশের মমতা তার দেহে মাখা, তিনি এ মাটির প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত-মস্তক। ভেতরের পলায়নপর অবসাদগ্রস্ততা তাঁকে পরাস্ত করতে পারে নি কখনো। আপাদমস্তক তিনি বাঙালি। বাংলার ‘দলহীন নদীর রেখায়’ রেখায় তাঁর অটোগ্রাফ শোভা পায় প্রতিনিয়ত। কিন্তু তিনি ক্লান্ত-অনুভবে টের পান- নাম ধাম টিকে থাকে না হয়তো চিরকাল। তিনি জানেন- ‘নির্জলা নামে প্রেম খুব শব্দহীনভাবে উঠে যায়’ অজানা অসীমাতায়। তাই ক্লান্ত প্রহরে কাদরীর মনে পড়ে :
সর্বত্র এবং যত্রতত্র লিখেছি আমার নাম-
বন্ধুর গ্রামের ভিটায়, পরিত্যক্ত রিক্ত কোনো
হানাবাড়ির সাঁতলা-পড়া পুরনো ইটায়, বাইজিদ বোস্তামীর
প্রাচীন ঘাটলার
মধ্যরাতে ঘর-ফেরা একাকী রাস্তায,
সিনেমার অসংখ্য-পোস্টারে, নামকরা নর্তকীর নামের ওপরে
নিদারুণ যত্নে বড়ো বড়ো অবিচল-হস্তাক্ষরে
লিখেছি আমার নাম।
(অটোগ্রাফ দেয়ার আগে : কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই)

এক সতেজ বিপর্যয় মানব সভ্যতার ‘মাথার ওপরে আবর্তিত’ শকুনের ছদ্মবেশে। ‘গোলাপের জলে বিন্দু বিন্দু ঘুর্ণিতে’ রক্তাক্ত লাশ হয়ে ভাসছে স্বজনের চেনা মুখ। বিশেষত নগরজীবনে কবি দেখেছেন ক্রমাগত ‘গড়িয়ে গড়িয়ে’ নেমে পড়ার দৃশ্য। যদিও দু একটি ‘নুয়ে-পড়া’ গাছের ডাল বন্ধুর সমর্থ হাতের মতো কড়মর্দনের জন্য এগিয়ে আসতে থাকে নগরবাসীর জীবনে। আর গ্রাম এক স্নিগ্ধচারণক্ষেত্র। সেখানকার জবিন ধবধবে চিতল। কেননা, ‘তাদের সোনালি খড়ের ভিটে আছে, গভীর কুয়োতলা আছে। খররৌদ্রে জিরানোর জন্যে পাথর এবং চত্বর আছে।’ অথচ শহরের জীবনে ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের উন্মুক্ত আলিঙ্গন। যেন আজন্ম উন্মুল মানুষ। নির্বিবেকি কাফনের আড়ালে দাঁড়িয়ে কবি-শোকহীন, মানবিক অহংকারে ঝকঝকে :
আমি তো শোকগ্রস্ত নই, টেলিফোনের ডায়াল ঘোরালে
প্রত্যেকে উত্তর দিচ্ছে যে যার নিজের ঘরে সুস্থ স্বাভাবিক।
তবু শোকের প্রস্তাব চারদিকে, জীবিতের মুখ যেন
মিশে গেছে মৃতের আদলে, শবযাত্রার মতো গম্ভীর মিছিলে
ছেয়ে গেলো আমার শহর, ভরে গেলো বঙ্গোপসাগরের গর্জনে।
(একটি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের জার্নাল : ওই)

শহীদ কাদরী অভিমানী-বড়ো অভিমানী। স্বদেশ থেকে দূরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে। মুধু স্বদেশ থেকে কেন, স্বভুবন থেকেও তিনি দূরে-অনেক দূরে আছেন। তিনি বিরলপ্রজ কবি (প্রকাশিত কাব্যগৃন্থ তিনটি-১. উত্তরাধিকার, ১৯৬৭; ২. তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, ১৯৭৪ এবং ৩. কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই, ১৯৭৮।) কবিতার পরিচিত পথে তাঁকে এখন আর দেখা যায় না। কী এক অজানা অভিমান তাঁকে বাংলা কবিতা থেকে, বাংলাদেশ ও বাঙালিদের ভিড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে! না-কি আছেন আমাদের প্রাত্যহিক গতিবিধির মৃদুধারায়। প্রকৃত অর্থে, ‘পাশ্চাত্য নাগরিকতার রুচি ও বৈদগ্ধ্য সত্তে¡ও শহীদ কাদরী অভিজ্ঞতার পরিচিতি ভূগোল কখনো অতিক্রম করেন নি। এমনকি গ্রামীণ নষ্টালজিয়া থেকেও যে তিনি পলায়ন করেন না, তাঁর অনেক উপমান-চিত্র থেকে তার ্রমাণ পাওয়া যায়।’ যদিও মৃত্তিকা-বিচ্যুতি-অনুভব তাঁর চেতনায় বিলোড়ন তোলে অনুক্ষণ। কাদরীর অনেকেত, উন্মুলিত সত্তার পরিচয় প্রকাশ পায় এভাবে :
না, শহীদ সেতো নেই; গোধূলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না।
নিসর্গে তেমন মন নেই, তাহরে ভালোই হতো
অন্তত চোখের রোগ সযত্নে সারিয়ে তুলতো হরিৎপত্রালি!

কিন্তু মধ্য-রাত্রির সশব্দ কড়া তার রুক্ষ হাতের নড়ায়
(যেন দুঃসংবাদ-নিতান্ত জরুরি) আমাকে অর্ধেক স্বপ্ন থেকে
দুঃস্বপ্নে জাগিয়ে দিযে, তারপর যেন মর্মাহতের মতন
...        ...        ...
সভার দরোজা খুলি-এইভাবে দেকা পাই তার-মাঝরাতে;
জানি না কোথায় যায়, কি করে, কেমন করে দিনরাত কাটে
চাকুরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা
মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে!

না, না, তার কথা আর নয়, সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো-শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।
(অগ্রজের উত্তর : উত্তরাধিকার)

স্বদেশের প্রতি অনিবার্য প্রবল টান অনুভব করেন শহীদ কাদরী। ‘তিনি স্বদেশ থেকে দূরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থেকেও বারবার আসেন বাংলাদেশের কবিতার পটভূমিকায়।’ তাকে আকর্ষণ করে-ইশারা দিয়ে ডাকে তাঁর শৈশব-কৈশোরের সেই ফেলে আসা উজ্জ্বল দিনগুলি। সেখানে-ফেলে আসা দিনে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা, অপ্রকাশিত ব্যথা প্রকাশ পেয়েছে কাদরীর কাব্যভাষায় :
অথচ আমাকে দ্যাখো, আমি
তার টানে, তারই টানে-টানে
ভেসে চ’লে গেছি মাছনদীতে একাকী খেলাচ্ছলে
চোরা ঘূর্ণির ভেতরে,
এখন আমি কোনো দিকেই আর যেতে পারছি না
সে কোন সকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার অঙ্গভঙ্গি
আমার ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার,
উবু-সাঁতার, মৃদু-সাঁতার দিতে-দিতেই আমার যেন বয়োবৃদ্ধি হলো,
জলের ওপর আমার কৈশোর, আমার যৌবন
কচুরিপানার মতো ভেসে
বেড়াচ্ছে কী দারুণ সবুজ!
(দাঁড়াও আমি আসছি : কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই)

দেশের-দশের সংকটের সময়; জটিল-আবর্তের সময় কেউ কেউ এসে দাঁড়ায় দশের পাশে, দেশের স্বার্থের দুয়ারে। সবাই-সব নাগরিক দেশের জন্য নিবেদিত-প্রাণ হয় না, হতে পারে না। আর এ কথাও ঠিক দেশমাটির প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা কৃত্রিমতায় আচ্ছাদিত থাকে না। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের সংখ্যা তাই আশংকাজনকভাবে কম। এ কথা সব দেশের, সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। বাংলাদেশে বিখাগোত্তরকালে এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে যে জটিলতা ও সংকট প্রবাহিত হচ্ছিল- তাতে অল্পকজন কল্যাণ-প্রত্যাশী মানুষ দেশের প্রতি বোধ জাগ্রত রেখেছিলেন-সচেতন ছিলেন প্রজ্ঞায় ও জ্ঞানে। শহীদ কাদরী সেই বিরল শুভবোধসম্পন্ন মানুষদের একজন। কবিতায় তাঁর এ বোধের অনুরণন আমরা শুনতে পাই :
শহর ছেড়ে চলে যাবে সবাই
(এবং চলে যাচ্ছে দলে দলে)
কিন্তু এই ধ্বংসস্তুপ স্পর্শ ক’রে আমরা কয়েকজন
আজীবন র’য়ে যাবো বির্দর্ণ স্বদেশে, স্বজনের লাশের আশেপাশে।
(নিষিদ্ধ জর্নাল থেকে : তোমাকে অভিবাদন প্রিয়মতা)

শহীদ কাদরী ‘আঁধার শহরে’র ‘অন্ধকার গলি’ পেরিয়ে ‘পরিত্যক্ত মূল্যবোধ’ অতিক্রম করে এখন ‘পরিত্যক্ত হাওয়ায় ওড়ানো কোন হলুদ পাতায়’ কিংবা উদ্ধত পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে-একা, জড়োসড়ো। তাঁর সামনে বিস্তীর্ণ জ্যোৎস্নায় উদোম হাওয়া। পেছনে কষ্টের, যন্ত্রনার প্রচণ্ড দাগ, রক্তাক্ত স্মৃতি। তিনি ভেসে চলেছেন প্রতিশ্রুতির সজল পুকুরে। ভাসতে ভাসতে বারবারই ফিরে আসেন স্বদেশের স্বাভাবিক ভুবনে। শহীদ কাদরী যেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে নেই-তাঁর ঠিকানা তার স্বদেশ-এই বাংলাদেশ।

ডক্টর ফজলুল হক সৈকত :

জন্ম ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া গ্রামে। নিবাস পূর্বে পুঠিয়া থানার মধুখালী গ্রাম বর্তমানে নাটোর সদরের একডালা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৯২ সালে অনার্স (মেধাতালিকায় প্রথম); ১৯৯৩ সালে মাস্টার্স (মেধাতালিকায় দ্বিতীয়) এবং ২০০৩-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। পরবর্তীকালে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এবং চাইনিজ ভাষায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বাবা মরহুম ডা. মো. আবুল হোসেন, মা মমতাজ বেগম, স্ত্রী জান্নাতুল পারভীন, পুত্র অনিরুদ্ধ অস্মিত সৌভিক, কন্যা সম্প্রতি সোপান শ্রেয়সী।

প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রবন্ধ-গবেষণা : শব্দসৌভিক বাংলা ব্যাকরণ ও রচনারীতি, তিরিশোত্তর কাব্যধারা ও আহসান হাবীবের কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা : বিষয় ও প্রবণতা, সরদার জয়েনউদ্দীনের কথাসাহিত্য : সমাজ ও সমকাল, অবসন্নতার অন্তরালে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা, কথাসাহিত্যের কথা, কবিতায় সমাজ ও রাষ্ট্র, সাহিত্যে গীতলতা ও প্রতিবাদ, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনা, ভাষা চর্চা ও শিক্ষা-পরিকল্পনা, বাংলা কবিতায় সমকাল, বাংলা লেখার নিয়ম, সাহিত্য ও সৌন্দর্য, বই বইমেলা ও প্রকাশনা।

সম্পাদনা : জসীম উদ্দীন : ঐতিহ্যের অহংকার, কথাশিল্পী আবু ইসহাক, জীবনানন্দ : কবি ও কথাশিল্পী, বাংলাদেশের সাহিত্য: বিষয় ও প্রবণতা, নজরুলের চিন্তাবিশ্ব, মুহম্মদ মতিউর রহমান : জীবন ও কর্ম, লালন : চিন্তা ও কর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব-জিজ্ঞাসা, কথানির্মাতা সেলিনা হোসেন, লালন সাঁই-এর জীবন ও গান;

ছোটদের বই : ছোটদের বাংলা লেখার নিয়ম, অনি-প্রীতির পাঠশালা। ছোটগল্প : বিড়ির আলোয় পরির মুখ। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের কিছু গ্রন্থের ভাষা-সম্পাদনা এবং কয়েকটি গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নাটোর জেলার কাফুরিয়া কলেজে অল্পকাল অবৈতনিক শিক্ষক হিশেবে কাজ করেছেন। অতঃপর ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে ঢাকা কমার্স কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে প্রকৃত কর্মজীবনের শুরু। ৯ জুন ২০০৫ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিশেবে কর্মরত; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেন থেকে প্রকাশিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় কবিতা, গল্প, সাহিত্য-সমালোচনা এবং কলাম লিখছেন।

পুরস্কার ও সন্মাননা :

বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান উপস্থাপক, পাণ্ডুলিপি লেখক ও সংবাদ পাঠক। বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ফররুখ একাডেমীর সদস্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে পেয়েছেন ‘উর্মি-ইসলাম পুরস্কার’, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮০ বাংলাদেশ প্রদত্ত ‘বেস্ট জোনাল কালচারাল অ্যাকটিভিটিজ অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৫’ এবং ‘বেস্ট প্রফেশনাল ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৬’ পেয়েছেন।

এছাড়া  শিল্প-সাহিত্য ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ক্যামব্রিয়ান কলেজ প্রদত্ত ‘বিশ্ব কবিতা দিবস বিশেষ সম্মাননা ২০০৯’ এবং উত্তর বাঙলা সংস্কৃতি পরিষদ প্রদত্ত ‘গবেষণা সাহিত্যে উত্তর বাঙলা বিজয় দিবস পদক-২০১১’ লাভ করেছেন। সুইডেন থেকে ‘অনুশীলন সাহিত্য পুরস্কার- ২০১৩’। বাংলাদেশ কবিতা পরিষদ থেকে ২০১৪ সালে ‘সরদার জয়েনউদদীন সম্মাননা’, ২০১৫ সালে সিএনসি প্রদান করে ‘সৈয়দ আলী আহসান পদক’।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!