• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিশপ্ত জঙ্গিবাদ: মৃত্যুর পরও পাশে থাকে না পরিবার


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৫, ২০১৭, ০১:৩৫ পিএম
অভিশপ্ত জঙ্গিবাদ: মৃত্যুর পরও পাশে থাকে না পরিবার

জঙ্গিবাদ রাষ্ট্রীয় কোনো সমস্যা নয়, এটি এখন সামাজিক অভিশাপে রূপ নিয়েছে। আর এ অভিশাপের চূড়ান্ত পরিণতি তীব্র ঘৃণা, মৃত্যু। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, জঙ্গিদের প্রতি তাদের পরিবারের লোকজনও এ ঘৃণা প্রকাশ করছে অবলীলায়। তাই নিহত জঙ্গিদের লাশ নিতেও অনীহা বাবা-মা কিংবা স্বজনদের। 

সম্প্রতি বিভিন্ন অভিযানে নিহত জঙ্গির স্বজনদের বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। এসব জঙ্গির অনেকেরই ছিল সুন্দর সাজানো সংসার। সুন্দর জীবন। সামাজিক মর্যাদা। কিন্তু বিপথগামিতায় হেঁটে আজ তারা সামাজিকভাবে ঘৃণিত। পরিবার বিচ্ছিন্ন। এমনকি মৃত্যুর পরও শেষ দেখা দেখতেও আসছেন না পরিবারের কেউ।

সর্বশেষ পুলিশের অভিযানে শীর্ষ জঙ্গি মারজানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার মা সালমা খাতুনের আক্ষেপে ভরা বক্তব্য ছিল- ‘সে (মারজান) তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। দেশের ক্ষতি করেছে আমার ছেলে। তার বিচার হইছে। আমি খুব খুশি। কিন্তু খারাপ লাগতাছে আমার ছেলে একটি নিষ্পাপ শিশু রেখে গেছে। ব্যাটার (ছেলে) বউটা জেলের ভেতর আছে। দেখার কেউ নাই।’ 

এদিকে গুলশান ঘটনায় নিহত ৬ জঙ্গির লাশ দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যালের হিমাগারে পড়ে থাকলেও কেউ নিতে আসেনি। গত বছরের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত ৯ জঙ্গির লাশও কেউ নেয়নি দাফনের জন্য। গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে আরেকটি অভিযানে জঙ্গিনেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ নিহত ৩ জঙ্গির লাশ নিতেও কেউ যোগাযোগ করেনি। 

এভাবে গুলশান হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে নিহত অন্তত ৪০ জঙ্গির লাশও গ্রহণ করেনি তাদের স্বজনেরা। শেষ পর্যন্ত জঙ্গিদের সেসব আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন হয় জুরাইন কবরস্থানে। মৃত্যুর পরও পরিবারের সহানুভূতি পায় না জঙ্গিরা।

এদিকে এ যাবৎ গ্রেফতার হওয়া নারী জঙ্গিদের অধিকাংশই এই বিপথগামিতার জন্য তাদের স্বামীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আত্মঘাতী হয় জঙ্গি তানভীর কাদেরী। ওই অভিযানে গ্রেফতার হন তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা। পরবর্তী সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বর্ণনা দেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্য কাহিনি। তিনি বর্ণনা দেন কীভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে তছনছ হয়ে পড়েছে তার সুখের সংসার। 

খাদিজা জানান, তার স্বামী উচ্চ বেতনে চাকরি করত। তিনি নিজেও এক লাখ ৯ হাজার টাকা বেতনে সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরি করতেন। দুই যমজ সন্তান পড়াশোনা করত রাজধানীর ভালো একটি স্কুলে। উত্তরায় ছিল তাদের নিজেদের ফ্ল্যাট। কিন্তু স্বামী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে বাধ্য করা হয় চাকরি ছাড়তে। একই সঙ্গে ছেলেদেরও স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। বিক্রি করে দেন ফ্ল্যাট। সব টাকা ব্যয় করা হয় জঙ্গি কাজে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তার স্বামী তাকে বাধ্য করেছে এ পথে আসতে। স্বামীর কারণেই তার সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেছে। এই দম্পতির এক সন্তান বর্তমানে আটক আছে। আরেক সন্তান আশকোনায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে।

এদিকে আশকোনায় জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন নারী জঙ্গি সাকিরা। ওই ঘটনায় তার শিশুসন্তান সাবিনা আহত হয়। সাকিরা ছিলেন পলাতক জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। শিশু সাবিনার নানা শাহে আলম চৌকিদার সংবাদ পেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন মেয়ের লাশ শনাক্ত করতে। এরপর তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাতনিকে দেখতে যান। 

এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মেয়ের কৃতকর্মের জন্য তিনি নিজেই একঘরে হয়ে আছেন। সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবেন। শিশুটি নানার কাছে গিয়ে ভালোভাবে বড় হয়ে উঠতে পারবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। কী করব ভেবে পাচ্ছিন না। সাবিনার মা-ই ওরে এতিম করল। আল্লাহ ছাড়া আর কে থাকল ওর? নাতনিরে দেইখা আর মন মানাইতে পারতেছি না। সাকিরার প্রতি ঘিন্না ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। ছোট বাচ্চারে কলঙ্ক দিয়া গেল। সাবিনা যেখানে যাবে মানুষ মনে করাইয়া দিব যে ওর মা কী ছিল। স্কুল-কলেজ-বিয়া সবখানেই এই কলঙ্ক থাকল।’

গত বছরের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে একপর্যায়ে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত নিহত জঙ্গি মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও মুসার স্ত্রী তৃষা দুই শিশু সন্তানসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিহত জঙ্গি নেতা মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাও এখন অনুতপ্ত। তিনি ফিরে যেতে চান তার দুই সন্তানের কাছে। 

শিলার মা জোহরা খাতুন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মেয়ে খুবই বিলাসী জীবন কাটিয়েছে। আর সেই মেয়ে আজ রিমান্ডে! কোলের সন্তানটা কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। জাহিদই (মেয়ে জামাই) আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে।’ স্বামীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষা মনি ওরফে তৃষাও।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রিমান্ডে তৃষা জানিয়েছে স্বামীর জঙ্গি কার্যক্রমকে ঘৃণা করতেন তিনি। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান তৃষার পক্ষে স্বামীকে ত্যাগ করাও সম্ভব ছিল না। এক সময় জঙ্গি আস্তানা থেকে পালানোর সুযোগও খুঁজতে থাকেন তিনি। তৃষা যে কোনো সময় পালিয়ে যেতে পাওে, এটা জানত মুসা। তাই স্ত্রীকে সবসময় কড়া নজরদারির মধ্যে রাখত। জঙ্গি আস্তানার বন্দি জীবন সম্পর্কে তৃষা গোয়েন্দাদের জানান, সেটা ছিল একটি জেলখানার মতো। স্বাভাবিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীবন!

এদিকে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আটক করা হয় মোহাম্মদপুরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মারজানের স্ত্রী প্রিয়তিসহ তিন জঙ্গির স্ত্রীকে। পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দাদের জিঙ্গাসাবাদে প্রিয়তি পুলিশকে জানান, মারজান ছিল খুবই স্বৈরাচারী। সে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে জঙ্গি কাজে সম্পৃক্ত করে। তা না হলে মারজান তাকে ত্যাগ করার হুমকি দিত। প্রিয়তি লেখাপড়া তেমন জানতেন না। বড় হয়েছেন মামার বাড়িতে। তাকে দেখভালের মতো কোনো অভিভাবকও নেই। তাই নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীর চাপে তিনি জঙ্গি কাজে জড়িয়ে পড়েন।

গত বছরের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় মায়ের আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া শিশু সাবিনা এখনো ঢাকা মেডিক্রাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সাত বছর বয়সী এই শিশুটির খোঁজ নিতে গত ২২ দিনেও স্বজনদের কেউ আসেনি। তবে শিশুটির মা শাকিরার পরিবার সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। নিঃসঙ্গ অবস্থায় শিশুটির দিন কাটছে। সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। লোকজন দূর থেকে দেখে, কিন্তু পুলিশ থাকায় কেউ কাছে এসে কথা বলারও আগ্রহ দেখায় না। শিশুটির পাহারায় ১০ পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তার মায়ের আত্মঘাতী বোমার স্পি্ন্টারে ক্ষত-বিক্ষত শিশুটি এখন আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে দেখতে দেখতে ২২টি দিন পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তার খোঁজ নিতে কেউ আসেনি। 

ফলে শিশুটিকে নিয়ে কী করা হবে, এ বিষয়ে পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, শিশুটির ব্যাপারে কোনো স্বজন আদালতে আবেদন করে তার জিম্মায় নিতে পারে। আর যদি কেউ না আসে অথবা নিতে না চায়, তাহলেও আদালতের সিদ্ধান্তমতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!