• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্ধ লক্ষাধিক অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক, প্রতারিত হচ্ছে রোগীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ৩০, ২০১৬, ০৩:৩৪ পিএম
অর্ধ লক্ষাধিক অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক, প্রতারিত হচ্ছে রোগীরা

দেশজুড়ে হাজার হাজার অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদেশে এমন সেন্টারের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারেরও। বার বার ঘোষণা দিয়েও দেশব্যাপী কার্যকর অভিযান অব্যাহত রাখতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। বরং স্বাস্থ্য অধিদফতরেরই কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা বিনিময়ে ওসব অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অর্থ কামানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।

তবে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে এলিট ফোর্স র‌্যাবের অভিযান প্রশংসিত হলেও ওই বাহিনীর পক্ষে ঘন ঘন অভিযান চালানো সম্ভব হয়ে ওঠছে না। ফলে দেশজুড়ে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিককে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে। ওসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোন সরকারী অনুমোদন। 

বরং কেউ কেউ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়েই সাজিয়ে বসেছেন হাসপাতালের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশজুড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা নামসর্বস্ব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই ওসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে নিরীহ মানুষকে ঠকাচ্ছে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে।

নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় বছরের পর বছর চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য। অভিযোগ তুলেও প্রতিকার মিলছে না। বরং কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়া হয় না। 

সেখানে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুততম সময়েই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছে।

ভুঁইফোড় ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগ বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বরং প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরা, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রওতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলাস্থানেই।

নিয়মানুযায়ী ওগুলো ইনসিনেটরে পোড়ানোর কথা। কিন্তু ওসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়েমুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। তাছাড়া মেডিকেল বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখার কারণেও মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। 

ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন্ কোন্ টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন।

মূলত ডাক্তারের কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা। আর ডাক্তাদের বেশি কমিশন দেয়ার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছেমাফিক টাকা-পয়সা আদায় করছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার। কিন্তু তার কোনো অস্তিত্বই নেই।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে বৈধ লাইসেন্সে মাত্র ৬ হাজার ৮৬৮ ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সেন্টারের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। ওসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সেবার নামে চলছে গলা কাটা বাণিজ্য। শুধুমাত্র রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৫টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৬৬০। 

কিন্তু বাস্তবে রাজধানীতে রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কাঁচামাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বনে বসে আছে। তাদের কাছে আধুনিক চিকিৎসাসেবার কোনো গুরুত্ব নেই। আছে শুধুমাত্র লাভের ফন্দিফিকির।

ওসব প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও আদতে তাদের কাউকেই সেখানে পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র রোগী আকর্ষণের জন্যই বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ তাদের মাসিক ফি দেয়া হয়। এমনকি বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নেই।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরকারি একটি রেট চার্ট দেয়া আছে। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫০০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫০০ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নির্ধারিত তালিকামূল্যের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ফি নেয়া হয়।

সূত্র আরো জানায়, বর্তমান সরকার নিরাপদ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর। সে লক্ষ্যে রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ এই অভিযান পরিচালনা করছে। তবে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণকেও সোচ্চার হতে হবে। কারণ ওসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

এ প্রসঙ্গেস্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ জানান, রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!