• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্বচ্ছ আয়-ব্যয়ে চলছে বিপিসি


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৮, ২০১৬, ০৮:২৫ পিএম
অস্বচ্ছ আয়-ব্যয়ে চলছে বিপিসি

বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) চলছে নামসর্বস্ব ও দুর্বল অডিট বিভাগ এবং অস্বচ্ছ আয়-ব্যয়ের মধ্য দিয়ে। অথচ বেসরকারি পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে এক হাজার কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলেই সেখানে একাধিক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসহ শক্তিশালী হিসাব বিভাগ থাকে। কিন্তু ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হলেও বিপিসিতে তা অনুপস্থিত। বর্তমানে বিপিসিতে আর্থিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা সর্বোপরি সুশাসন নিশ্চিত করতে একটি অডিট বিভাগ থাকলেও তা অনেকটাই নামসর্বস্ব। বর্তমান ওই বিভাগে কোনো কর্মীই নেই। বিপিসি ও সিএজি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বিপিসির অডিট বিভাগের দায়িত্ব আছেন একজন মহাব্যবস্থাপক। তবে তিনি এখন বিদেশে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। তাছাড়া এ বিভাগ বিপিসির বার্ষিক আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসানের আর্থিক বিবরণীও তৈরি করে না। বরং বাইরের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান (সিএ ফার্ম) দিয়েই বছর শেষে অডিট প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তাছাড়া অর্থবছর শেষে বহিঃনিরীক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অডিট করার কথা থাকলেও গত ৩ বছরেও তা করা হচ্ছে না। যদিও বর্তমানে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অডিটের জন্য এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) ও ওরাকলসহ উন্নত মানের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিপিসি ব্যবহার করছে এখনো টালি সফটওয়্যার। ফলে অনেকটা দায়সারাভাবেই চলছে আয়-ব্যয় ও লাভ-লোকসানের হিসাব। পাশাপাশি সহযোগী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রলিয়াম, যমুনা অয়েল, ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যে বিল, ভাউচার ও হিসাব দিচ্ছে তা-ই চূড়ান্ত করছে বিপিসি।

সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন ও জাহাজ ভাড়ায় অনিয়ম জিইয়ে রাখতেই দীর্ঘদিন ধরে বিপিসির অডিট বিভাগকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। এজন্য ওই বিভাগে কাজের পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় জনবল সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ বিপিসির অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী অডিট বিভাগে একজন মহাব্যবস্থাপক, একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক, একজন সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক, একজন ব্যবস্থাপক, একজন উপ-ব্যবস্থাপক, একজন সহকারী ব্যবস্থাপক ও একজন জুনিয়র কর্মকর্তাসহ ১০ জন জনবল থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেখানে এখন কেউ নেই। তবে নিয়ম রক্ষার জন্য কিছু নিরীক্ষা করা হলেও ওসবই লোক দেখানো। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়, কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয় ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিপিসির হিসাব ও অডিট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে। দাতা সংস্থা আইএমএফ বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির অডিট করানোর জন্য সরকারকে চাপ দিলেও তা কাজে আসেনি। অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও তাতে কাজ হয়নি। বরং আগের নিয়মেই চলছে বিপিসি।

সূত্র আরো জানায়, বিপিসির অপারেশন ও ফিন্যান্স-সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিসাব ও অডিট নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সেখানে বলা হয়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের হিসাবে নগদ প্রবাহে গড়মিল রয়েছে। ওই অর্থবছর শেষে ১ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার একটি হিসাব দেখানো হয়েছে। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর সেটি নগদ প্রবাহে ঘাটতি না উদ্বৃত্ত হিসেবে বিবেচিত হবে তার উল্লেখ নেই। শক্তিশালী অডিট বিভাগ না থাকায় এ ধরনের সমস্যা হয়েছে বলে ওই কমিটি জানায়। তাছাড়া ২০১৩ সালে সিএজি কার্যালয় পরিচালিত বিপিসির ইফিশিয়েন্সি অডিট প্রতিবেদনেও প্রতিষ্ঠানটির অডিট বিভাগ নিয়ে নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ না থাকায় স্বচ্ছ নিরীক্ষা ছাড়াই সব আয় ও ব্যয়ের বিল পাস হচ্ছে। ফলে বিপিসির সব ধরনের লেনদেন ও হিসাব-নিকাশে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকছে না।

এদিকে সিএজি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিপিসির আওতাধীন পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রলিয়াম লিমিটেডের বার্ষিক হিসাবের সাথে বিপিসির হিসাব ৮ বছর মিলিয়ে দেখা হয়নি। এ কারণে ওসব কোম্পানির সাথে বিপিসির হিসাবে অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত গড়মিল রয়েছে। শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যের হিসাবেই চারটি কোম্পানির সাথে বিপিসির হিসাবে গড়মিল হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ একটি প্রতিষ্ঠানের অডিট বিভাগ রাখাই হয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে বিপিসিসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানে অডিট বিভাগ দুর্বল হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে না। বরং সেখানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাই বেশি ভর করবে।

অন্যদিকে বিপিসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় জনবল, কাজের পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া বিপিসির মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়। অথচ প্রয়োজনের চেয়ে ৫ ভাগের একভাগ জনবল দিয়ে বিপিসি চলছে। বিপিসিতে কেবল জনবলই সংকট নয়, রয়েছে দক্ষ কর্মীও সংকট। তাছাড়া একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠানে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তার কোনোটিই বিপিসিতে নেই। বর্তমানে বিপিসিতে জনবল রয়েছে ১১৬ জন। ৪৪৭ জন জনবল প্রস্তাব দিয়ে নতুন অর্গানোগ্রাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা পাস হচ্ছে না। তাছাড়া শূন্য পদে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও মন্ত্রণালয় থেকে রয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। এসব কারণে বিপিসি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

জনবলশূন্য অডিট বিভাগ সম্পর্কে বিপিসির চেয়ারম্যান এএম বদরুদ্দোজা বলেন, বিপিসির সব বিভাগে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তার মধ্যে অডিট বিভাগে ঘাটতি বেশি। তবে সমন্বয় সভায় জনবল নিয়োগ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেজন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি একটি আধুনিক অফিসের জন্য যা যা দরকার সে বিষয়ে পরিকল্পনা করে একটি প্রতিবেদন দেবে। আর ওই  প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বিপিসির অডিট বিভাগসহ সব বিভাগকে ঢেলে সাজানো হবে।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!