• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আই অ্যাম স্যরি!


নিউজ ডেস্ক অক্টোবর ২১, ২০১৭, ১০:৫২ এএম
আই অ্যাম স্যরি!

ঢাকা: মিয়ানমারে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার উপর প্রতিবেদন করতে এসে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি জেফ্রেই গ্রেটেলম্যানের জীবনে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় নিপীড়িত মানুষের ওপর প্রতিবেদন করলেও রোহিঙ্গাদের চলমান বাস্তবতা থমকে দিয়েছে তাকে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা শুনে তাদের সান্তনা দেয়ার মতো কিছু বলতে না পেরে কিংবা তাদের জন্য কিছু করতে না পেরে শুধুমাত্র বাংলায় তাদেরকে 'আমি দু:খিত' বলা ছাড়া কিছু করার নেই বলে মনে করেন তিনি। নিউ ইয়র্কে টাইমসে প্রকাশিত তার একটি প্রতিবেদনের চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

তিনি বলছেন, শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার পরই আমার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আমি ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে? উত্তরে আমি বলি, আমি জীবনের সবচেয়ে খারাপ সাক্ষাৎকারটি শেষ করলাম।

আমি বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে দাঁড়িয়েছিলাম যেখানে মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে প্রায় আধা মিলিয়ন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন আর তারাই হয়ত দুনিয়ার সবচেয়ে অপ্রার্থিত জাতি। আমি কেবলমাত্র রাজুমা নামের এক রোহিঙ্গা নারীকে বিদায় জানালাম। কিছুক্ষণ আগে যে আমাকে জীবনের সবচেয় দুঃখের গল্পটি শুনিয়েছে।

প্রতিবেদক বলছেন, আমি সুদানের গণহত্যা এবং যুদ্ধ কবলিত ইরাকের শিশুদের নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। আমি ভূমিকম্প, হারিকেন, সিভিল ওয়ার, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, বিদ্রোহী এবং দুর্ভিক্ষপিড়ীতদের নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের এমনটাই করতে হয়। গত ২০ বছর ধরে এমন কাজ করতে করতে আমি নিপীড়িত লোকদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ বনে গেছি।

তবে রাজুমার গল্প আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

রাজুমা আমাকে জানাল, মিয়ানমার সরকারের সেনারা আগস্ট মাসে তাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ সময় তারা পুরুষদের নিকট হতে নারীদের আলাদ করে ধর্ষণ করে।

রাজুমা বলেন, ধর্ষণের পূর্বে সেনারা আমার সন্তানকে আমার নিকট হতে কেড়ে নেয় এবং তাকে আগুনে নিক্ষেপ করে।

প্রতিবেদক বলছেন, আমরা একজন অনুবাদকসহ একটি কুঁড়েঘরে বসে ছিলাম। আমরা তিনজন ছোট প্লাস্টিকের টুলে বসে থাকলেও রাজুমার গল্প শুনে আমরা নুয়ে যাচ্ছিলাম। তার চোখ দিয়ে যখন পানি পড়ছিল তখন আমার কপলে ভাঁজ পড়ে যাচ্ছিল এবং নিজের প্রতিই রাগ হচ্ছিল।

প্রতিবেদক বলছেন, কেন আমি তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলাম? কেউ কি এতটা ভয়াবহ গল্প পড়বে? আমি এটা লিখতেও চাই না।

আমার মনে হচ্ছিল যে আমি অসাড় হয়ে যাচ্ছি। শরণার্থী ক্যাম্পে প্রথম দিনে রোহিঙ্গাদের এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার কিছুটা খারাপ লেগেছিল। আমি কিছুটা মর্মাহত হয়েছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারলাম দশকের পর দশক তারাও জার্মানির ইহুদিদের এবং রুয়ান্ডার গণহত্যার শিকার মানুষেদের মতো নিপীড়িত হচ্ছেন।

আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমি যদি এ ঘটনা কাভার না করি তবে তা আরও খারাপ হবে। এটা তাদের প্রতি অবিচার হবে, রোহিঙ্গা মানবতাকে আরও লাঞ্ছিত করা হবে। এটা রাজুমাকে এমনটা বলা হবে যে, বিশ্ব তার নিপীড়ন নিয়ে কিছুই ভাবছে না।

সাক্ষাৎকারটি শেষ করা আমার জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। আমরা যখন তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন আমার কী করা উচিত কিংবা কী বলা উচিত সেটা ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি। নিজের ওয়ালেটের সবগুলো ডলার তাকে দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিংবা তার সঙ্গে কোলাকুলি করতে চেয়েছিলাম। নিজেকে এমন অসহায় ভাবা একজন সাংবাদিকের জন্য সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত।

আমরা খবর সংগ্রহ করি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নেই কিন্তু এনজিও কর্মী নই। তবে আমার সামনেই যদি রাজুমার রক্তপাত ঘটত এবং আমার সহায়তার প্রয়োজন হতো তবে অবশ্যই সেটা করতে আমি একবারও ভাবতাম না। তবে এটা সেই মুহূর্ত ছিল না। তার বাচ্চা মারা গেছে এবং সারা জীবনই তাকে এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে।

আমি অল্প কিছু বাংলা শব্দ শিখেছি এবং এগুলোর ব্যবহারও আমি সবেচয়ে বেশি করেছি। সবকিছু হারিয়ে এখানে স্থান নেওয়া কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে আমি এই শব্দগুলোই বলেছিলাম। কিছু সময়ে বলার জন্য শুধুমাত্র এই শব্দগুলোই আছে।

রাজুমার সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। সেই মুহূর্তে যেটা করা আমার জন্য সবচেয়ে উত্তম কাজ হবে বলে মনে করলাম সেটাই করলাম।

আমি তাকে বললাম, আমি দু:খিত।

আই অ্যাম স্যরি।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!