• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিগগিরই ‘করণীয় কমিটি’

আটটি কবরসহ সরানো হচ্ছে ২০ স্থাপনা


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৪, ২০১৬, ০১:০০ এএম
আটটি কবরসহ সরানো হচ্ছে ২০ স্থাপনা

ঢাকা: স্থপতি লুই আই কানের তৈরি করা জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা নিয়ে খুব দ্রুতই সরকারের উচ্চপর্যায়ে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। কার্যত এসব বৈঠকেই নির্ধারণ হয়ে যাবে সংসদ ভবনের নকশাবহির্ভূত যেসব স্থাপনা রয়েছে তা সরিয়ে ফেলার। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ সচিবালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, জাতীয় জাদুঘর, স্থাপত্য অধিদফতর ও জাতীয় আর্কাইভসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে শিগগিরই ধারাবাহিকভাবে এসব বৈঠক হতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের ‘মূল নকশা নিয়ে করণীয়’ সম্পর্কিত একটি ‘কমিটি’ দু-এক দিনের মধ্যে গঠন করা হবে বলে সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কী কী থাকবে এবং কী কী স্থাপনা সরিয়ে নেয়া হবে তা সম্ভাব্য ওই ‘কমিটি’ই নির্ধারণ করবে।

মূল নকশা সরকার বাস্তবায়ন করলে সংসদ এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হতে পারে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনসহ ছোট-বড় বেশ কিছু স্থাপনা। পাশাপাশি সরানো হতে পারে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি, সবুর খানের কবরসহ আটটি কবর। আর নকশাবহির্ভূত স্থাপনা অপসারণের পর সেখানে জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি, জাদুঘর ও প্রশাসনিক সচিবালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদ ভবনের নকশাবহির্ভুত সব স্থাপনা সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। চলতি বছরের ৬ অক্টোবর সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদকে জানান, স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশা দেশে আনার পর জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। 

আর গত শুক্রবার গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংসদ ভবনের নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনাই সরিয়ে নেয়া হবে। এমকি মূল নকশা বাস্তবায়ন হলে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও থাকবে না। প্রয়োজনে সংসদ ভবন এলাকা থেকে সেটিও সরিয়ে নেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, শুধু জিয়াউর রহমানের কবর কেন, বিধিবহির্ভূত কিছুই জাতীয় সংসদ এলাকায় থাকবে না। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই এসব স্থাপনা সরানো হবে। এই কাজে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। 

স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির জানিয়েছেন, যেহেতু মূল নকশা পাওয়া গেছে, সে কারণে এখানে অস্পষ্টতার কিছু থাকবে না। তবে স্থপতি লুই আই কান সম্পর্কে যারা ভালো জানেন অথবা তার সম্পর্কে পড়ালেখা রয়েছে এমন স্থপতিদের নিয়ে এটা আরো যাচাই-বাছাই করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। 

তারপর গণপূর্ত অধিদফতর প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কারকাজ শুরু করবে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বড় স্থাপনাগুলোর ক্ষেত্রে সহসা সিদ্ধান্ত না এলেও কবরের মতো ছোট ছোট স্থাপনাগুলো দ্রুতই সরিয়ে ফেলা হবে। 

তিনি আরো বলেন, স্থাপনাগুলো সরানোর জন্য সরকার এত দিন লুই আই কানের নকশার জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন নকশাটা হাতে আসায় পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে দেরি হওয়ার কথা নয়।

৪০টি বাক্সে জাতীয় সংসদের মূল নকশার চারটি করে সেট যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার আর্কিটেকচারাল আর্কাইভ থেকে গত বৃহস্পতিবার দেশে আনা হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে সংসদ সবিচালয়ের অতিরিক্ত সচিব এওয়াইএম গোলাম কিবরিয়া জানান, নকশাগুলো ওই দিনই জাতীয় সংসদের স্পিকারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, এই নকশা আনার জন্য সরকার প্রায় চার লাখ ডলার বরাদ্দ করে, যা বাংলাদেশি টাকায় তিন কোটি ২০ লাখ টাকার কাছাকাছি।

এদিকে হাতে পাওয়া নকশাগুলো নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে-জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, নকশাগুলো সংসদ সচিবালয় তথা বাংলাদেশের সম্পদ। দীর্ঘদিন এগুলো আমাদের কাছে ছিল না। নকশাগুলো সংগ্রহ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীরও তাগিদ ছিল। নিজেদের সম্পদ হিসেবে সংসদ সচিবালয়ে নকশাগুলো সংরক্ষণ করা হবে। 

তিনি বলেন, ‘আমরা মোট ৮৭৩টি নকশা ও ৫৫টি ডকুমেন্ট হাতে পেয়েছি। এখন হয়তো এগুলো ভাগ করে সংশ্লিষ্ট দফতর বা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা হবে। তবে এ কাজগুলো করার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় থাকা অন্যান্য কবর সরিয়ে নেয়া হবে বলে পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বারবার যে কথা বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘পূর্ত মন্ত্রণালয় বা সরকারের বক্তব্য সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কারণ সেটা সরকারের ব্যাপার। সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্ব হলো নকশাগুলো সংরক্ষণ করা। এর বাইরে পূর্ত মন্ত্রণালয় বা সরকারের কী পরকিল্পনা আছে বা করবে সেটা স্পিকার হিসেবে আমার বলার বিষয় নয়।’ 

সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরানো হচ্ছে যেসব স্থাপনা :
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য ব্যয় ধরে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের নকশা অনুযায়ী সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।

স্থপতি লুই আই কানের নকশায় শেরে বাংলানগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। এই যুক্তিতে সেখানকার কবর সরানোর পক্ষে একাধিকবার মত দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। 

লুই আই কানের নকশার বাইরে সংসদ ভবনের ভেতর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর রয়েছে।

এই আটটি কবর ছাড়া শেরে বাংলানগরে আছে লুই কানের নকশাবহির্ভূত আরো সাতটি স্থাপনা। এগুলোর মধ্যে বড় স্থাপনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিআইসিসি), স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন। এর বাইরে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরের চারদিকে থাকা চারটি প্রবেশপথের শুরু বা শেষ প্রান্তে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সম্মেলন কেন্দ্র ও মসজিদসহ চারটি স্থাপনা। 

সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ মারা গেলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সংসদ ভবনের ‘জাতীয় কবরস্থানে’ দাফন করার জন্য জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কাছে অনুমতি চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু তাতে সম্মতি দেয়া হয়নি। 

এর আগে জাতীয় সংসদ ভবন সীমানার পূর্বপ্রান্তে আসাদগেটের উল্টো দিকের পেট্রলপাম্পটি তুলে দেয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তখনকার মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ভাইকে জায়গাটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।

লুই আই কানের মূল নকশা অনুযায়ী, সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের পাশাপাশি নতুন সচিবালয়ও শেরে বাংলানগরে হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি সরকার সেখানকার ১০ একর জমিতে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে, যা পরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নামে নামকরণ করা হয়। এখন সরকার আবার সেখানে সচিবালয় স্থানান্তর করতে চাইলেও লুই আই কানের মূল নকশা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। 

এর আগে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদে বেশ কয়েকবার বলেছেন, কবর তো বনানী, আজিমপুর বা মিরপুর কবরস্থানে হওয়ার কথা। কবর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় হবে কেন? তা ছাড়া লুই আই কানের নকশার কোথাও শেরে বাংলানগরে কবরস্থানের জন্য জায়গা নির্ধারিত ছিল না।

গত বছর জাতীয় সংসদ ভবনের নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ এলে আলোচনায় আসে সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশার বিষয়টি। 

এ ছাড়া লুই কানের নকশা ভেঙে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তখন ভবন দুটি তৈরি হয়। এ-সংক্রান্ত একটি মামলা এখনো বিচারাধীন। এই প্রেক্ষাপটে গত বছরের ৪ নভেম্বর লুই আই কানের মূল নকশা দেখতে চান আপিল বিভাগ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!