• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
কনডেম সেলে বিষন্ন তারেক-নূর হোসেনরা  

আতঙ্কের নারায়ণগঞ্জে স্বস্তি


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৮, ২০১৭, ১২:১৩ পিএম
আতঙ্কের নারায়ণগঞ্জে স্বস্তি

নারায়ণগঞ্জ: কারাগারের নিঃসঙ্গ সেলে এখন দিন কাটছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার ফাঁসির সাজা পাওয়া আসামিদের। একসময় যারা আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আধিপত্য কায়েম করেছিল, এখন তাদের এসে দাঁড়াতে হয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি। নিঃসঙ্গতা আর বিষন্নতা গ্রাস করেছে তাদের। অন্যদিকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জে ফিরতে শুরু করেছে স্বস্তি। গুম, খুন, সন্ত্রাস আর মাদক চোরাকারবারিদের এ স্বর্গরাজ্যে বইতে শুরু করেছে শান্তির সুবাতাস। সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিরতে শুরু করেছে আস্থার পরিবেশ। সেইসঙ্গে দেশবাসীর মধ্যেও নতুন করে ধারণার জন্ম নিয়েছে যে, অন্যায় করে সব সময় পার পাওয়া যায় না। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই অপরাধীকে একসময় দাঁড়াতেই হয় কাঠগড়ায়। জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় নিজের দুষ্কর্মের। তাই নারায়ণগঞ্জবাসীরও এখন একটাই চাওয়া- যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করা হোক।   

ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একসময়ের শহর হিসেবে সুপরিচিত নারায়ণগঞ্জ সামরিক সরকারের আমলে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় সন্ত্রাসের জনপদে। অপহরণ, গুম, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নদীদখল, ভূমিদস্যুতা হয়ে দাঁড়ায় এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী,  নারায়ণগঞ্জে প্রতি বছর শতাধিক মানুষ খুন ও অপহরণের শিকার হয়। 

নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে সাতখুনের ঘটনা এবং পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনা সারা দেশকে নাড়া দেয়। এছাড়া ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম, বুলু সাহা, সংস্কৃতিকর্মী দিদারুল আলম (চঞ্চল), ছাত্রলীগ কর্মী মিঠু এবং মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশব্যাপী সমালোচিত হয়। ত্বকী হত্যার পরে নারায়ণগঞ্জে নাগরিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা বেশ কিছু দিন অব্যাহত ছিল। এ হত্যার বিচার আজও সম্পন্ন হয়নি। তার পরও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সাতখুন মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ায় নারায়ণগঞ্জবাসী এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠছে। এসব হত্যার বিচারের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জকে কলঙ্কমুক্ত করতে চায় এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষ। সাতখুনের বিচারের আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় পৌরসভা, এলজিইডি, জেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, গণপূর্ত, সওজ, পিডিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দফতরের দরপত্র, পরিবহন ব্যবসা, চোরাই তেল, অবৈধ বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী ক্যাডারদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। এতেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ ভীষণ খুশি। তারা চান সাতখুনের ঘটনার মতো এসব ক্যাডারদেরও  দ্রুত বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা হোক।   

এদিকে নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ জনকে নারায়ণগঞ্জ ও কাসিমপুর কারাগারের হাই-সিকিউরিটি জোনে রাখা হয়েছে। গত সোমবার রাতেই তাদের কনডেম সেলে নেয়া হয়। তাদের এখন নিঃসঙ্গ সেলেই থাকতে হবে।

কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কাসিমপুর-১ ও কাসিমপুর-২ কারাগারে আছে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া বেশিরভাগ আসামি। ডিআইজি (প্রিজন) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার পর মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সব আসামি কনডেম সেলে আছে।

ফাঁসির সাজা পাওয়া বাকি ১২ জনকে বন্দির পোশাকে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির কক্ষে রাখা হয়েছে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এছাড়া এ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ পাওয়া আরো ছয় আসামিকে রাখা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে। তিন বছর আগের ওই হত্যার দায়ে আদালত গত সোমবার মোট ৩৫ জনের সাজার আদেশ দিলেও তাদের মধ্যে ১২ জন পলাতক রয়েছে। 

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত সোমবার এ মামলার রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। রায় ঘোষণার পর সোমবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন, ক্যাম্প কমান্ডার চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা ও ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেনকে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে।  

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জেলার নাশির আহমেদ জানান, কারাগারে পৌঁছানোর পরপরই মৃত্যুদণ্ডের পাঁচ আসামিকে সাদা-কালো ডোরাকাটা বন্দির পোশাক পরানো হয়।
কারা কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী রাতেই তাদের ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ কনডেম সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাদের বেশ চিন্তিত বলে মনে হয়েছে। গত সোমবার রায়ের পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক আসামির ভাই কারাগারে এসে দেখা করে গেছেন। তবে নূর হোসেন বা তারেক সাঈদের কেউ আসেননি।

নারায়ণগঞ্জ কারাগারে এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ১২ আসামিকে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাতজন সাবেক র‌্যাব সদস্য, বাকিরা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি নূর হোসেনের সহযোগী।

নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার মো. আসাদুর রহমান জানান, তার কারাগারে ফাঁসির আসামিদের সেল রয়েছে ১৫টি। জায়গা না থাকায় সাতখুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামিকে আলাদা সেলে রাখা যায়নি। এক সেলে রাখা হয়েছে তিনজন করে। তাদের সাজাপ্রাপ্ত বন্দির পোশাক পরিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া নারায়গঞ্জ কারাগারে আরো ১২ জন ফাঁসির আসামি আছে। তারা যেভাবে রয়েছে, নতুনদেরও সেভাবে রাখা হয়েছে।

আসাদুর রহমান বলেন, সোমবার কনডেম সেলে নেয়ার পর এই ফাঁসির আসামিদের রাতে সবজি, ডাল, ভাত ও মাছ খেতে দেয়া হয়। মঙ্গলবার সকালে দেয়া হয় রুটি আর গুড়। তারা তা খেয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার এমদাদুল হক, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, আসাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশারকে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে রাখা হয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল রুহুল আমিন, সৈনিক নুরুজ্জামান, আবুল কালাম আজাদ, এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনও আছে এ কারাগারে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন এর আগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। এ কারণে তাকে প্রধান চার আসামির সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছে।

এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম বর্তমানে ভারতের কারাগারে বন্দি। এছাড়া সানা উল্লাহ ওরফে সানা, নূর হোসেনের ম্যানেজার শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আল আমিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সৈনিক আবদুল আলিম পলাতক রয়েছে। এছাড়া পলাতক তিন আসামি কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেনকেও কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালতে।

নিয়ম অনুযায়ী নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে যাবে। আসামিরাও আপিলের সুযোগ পাবে। হাইকোর্টের রায়ের পর আপিল বিভাগেও যাওয়ার সুযোগ থাকবে। এই বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকর করা যাবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!