• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আবহাওয়ার বদল, বিপর্যস্ত কৃষিখাত


শেখ আবু তালেব ও হৃদয় আজিজ এপ্রিল ২৪, ২০১৭, ০৮:০৮ পিএম
আবহাওয়ার বদল, বিপর্যস্ত কৃষিখাত

ঢাকা: আবহাওয়ার বদলের কারণেই অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে ঋতু পরিবর্তন। দেখা দিচ্ছে অসময় বৃষ্টি কিংবা আগাম বৃষ্টি। একই সঙ্গে সময়ের আগেই হাজির হচ্ছে বর্ষাকাল। অন্যদিকে শীতের আগমন প্রতিবছরই যাচ্ছে পিছিয়ে। আর এসব পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক সময় হয়ে পড়ছে অস্বাভাবিক।

আবহাওয়া আর জলবায়ুর এই পরিবর্তনে দ্রুততম সময়ে খাপ খেয়ে নিতে পারছেন না কৃষকরা। সে কারণেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে কৃষিখাত। অসময়ে প্রবল বর্ষণ, আকস্মিক বন্যার তোড়, তীব্র খরা কিংবা প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের কারণে ফসল বিপর্যয় ঘটছে। হুমকির মুখে পড়ছে অনেক এলাকার সেচ নির্ভর কৃষি।

বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উৎপাদনের ওপরই নির্ভরশীল এর অর্থনীতি। আর কৃষি উৎপাদন প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে আবহাওয়া আর জলবায়ুর ওপর। বিশেষত, বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রার উঠা-নামা আর উজানের ঢলের কারণে নদ-নদীর পানির গতিপ্রকৃতি কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

গেল কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতির অস্বাভাবিকতার শিকার হতে হচ্ছে কৃষি খাতকে। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানি প্রবাহ একদমই কমে গেছে। শুকনা খালে পরিণত হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা নদীগুলো। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। প্রচণ্ড গরমে তাপদাহের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সেচ প্রধান কৃষিখাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।

একইভাবে অতিবৃষ্টি কিংবা আগাম বৃষ্টির কারণেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এর ওপর হঠাৎ উজান থেকে নেমে আসছে প্রবল ঢল। এতে ভেঙে যাচ্ছেন অস্থায়ী বাঁধ। প্লাবিত হচ্ছে শত শত হেক্টর জমির ফসল। উজানের ঢলের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অতিবর্ষণের পানির তোড়। এতে অনেক শহরে অসময়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। উঠতি অনেক ফসল অতিবর্ষণ সহ্য করতে না পেরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আবহাওয়া কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, গেল তিন দশকের মধ্যে এবারই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা পুরোটাই অস্বাভাবিক। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাভাবিকের তুলনায় দেশে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ১১৯ শতাংশ। মাসের বাকি সময়টা আর বৃষ্টি না হলেও শুধু এ মাসেই স্বাভাবিকের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড থাকবে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে।

আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, গ্রীষ্মকালের প্রথমে বৈশাখের এ সময়টাতে যখন খটখটে রোদ থাকার কথা, সেখানে গত কয়েকদিন দেশব্যাপী অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। বৃষ্টির কারণে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগে পড়েছে হাওরাঞ্চলে মাসের শুরু থেকেই আকস্মিক বন্যার শিকার মানুষেরা। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে প্রবল বর্ষণ এবং অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাসন ব্যবস্থার কারণে অনেক রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। রাজধানী ঢাকায়ও সাময়িকভাবে ডুবে গেছে বেশ কিছু রাস্তা।

হঠাৎ এই অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পশ্চিমা লঘুচাপ দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকায় অসময়ে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। গত মাসেও বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল।

সূত্রমতে, গেল ৩৭ বছরে আট বার এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে স্বাভাবিকের তুলনায় ১৬৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা ৩০/৩৫ বছরের আবহাওয়ার গড় ফলকে জলবায়ু হিসেবে ধরি। এ হিসেবে দেশে জয়বায়ুর পরিবর্তন যে হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, এবারের গ্রীষ্মকাল বর্ষাকালকেও হার মানাচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই প্রবল বর্ষণ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক অঞ্চলের নিচু এলাকা তলিয়ে গেছে। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণে পুরো মহানগর জুড়েই থৈ থৈ পানি। জলাবদ্ধতায় চরম বিপাকে পড়েছে সে নগরের বাসিন্দারা।

অসময় বন্যা

স্বাভাবিকভাবে গ্রীষ্মকাল মানেই কাঠ ফাটা রোদ, উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা কালবৈশাখী, প্রবল ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি। এরপরই আকাশ পরিষ্কার। ঠা ঠা রোদ। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই গ্রীষ্মকালের চিরাচরিত এই রূপের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন অভিজ্ঞতা বলছে, বৈশাখ মাস মানেই বেধড়ক বৃষ্টি। কখনও ঝিরি-ঝিরি, কখনও মুষলধারে।

আবহাওয়ার পরিবর্তনের মধ্যে আর একটি বিষয় ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। গেল তিন/চার বছরে বজ্রপাতের প্রকোপ বেড়েছে। আর বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানির সংখ্যাও অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রকৃতির এ চরিত্র পরিবর্তনের পেছনে বাতাসের উপাদানের ভারসাম্য পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বৈশাখ মাসে বর্ষাকালের মতো বর্ষণের জন্য আবহাওয়ার পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। ঋতুর স্বাভাবিক বৈশিষ্টগুলো আর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। পরিবর্তিত এসব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খেয়ে নিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রাণিকূলকে।

আবহাওয়ার পরিবর্তনের বড় দৃষ্টান্ত অসময়ে ঢল। চলতি মাসেই সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার শতাধিক হাওরের চিত্র পাল্টে গেছে। যে সময় হাওরগুলোতে ধান কাটার ধুম পড়ার কথা তখন সেখানে চলছে হাহাকার। আকস্মিক ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অকালসৃষ্ট বন্যায় ওইসব জেলার হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে লাখ লাখ হেক্টর জমি ধান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কৃষক পরিবার। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে এখন বিরাজ করছে বর্ষার পরিবেশ।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন এভাবেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এর ওপর ‍যুক্ত হতে পারে বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব। হিমালয়ের বরফ গলার মাত্রা বাড়তে থাকলে এ অঞ্চলে এসব বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো তলিয়ে যেতে পারে। যা হবে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়।

মনে হচ্ছে বর্ষাকাল, আসলে বৈশাখ!

সোনালীনিউজ/এন 

Wordbridge School
Link copied!