• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
সোনালীনিউজের আড্ডায়

আমার পুরোটা হৃদয় জুড়ে গান: মনির খান


বাবুল হৃদয় নভেম্বর ২৯, ২০১৭, ০৩:৩৯ পিএম
আমার পুরোটা হৃদয় জুড়ে গান: মনির খান

সোনালীনিউজ কার্যালয়ে কণ্ঠশিল্পী মনির খান

ঢাকা: ‘তোমার কোন দোষ নেই’, তোমার ছেলে আজ বড় হয়েছে’, ‘শুধু মা নেই, শুধু মা নেই, আট আনার জীবন, চার আনা ঘুমে, চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে’  ইত্যাদি জনপ্রিয় গান। সিনেমার গানে শ্রেষ্ঠ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

বলছি দেশের আধুনিক গানের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী মনির খানের কথা। সম্প্রতি এই গায়ক এসেছিলেন সোনালীনিউজ ডটকম কার্যালয়ে। জম্পেশ আড্ডায় ব্যক্তিজীবন ও সঙ্গীত নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পীর বর্নাঢ্য গানের জীবন পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সোনালীনিউজ ডটকমের বিনোদন ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান বাবুল হৃদয়।

সোনালীনিউজ:  আপনার জন্ম ও শৈশব কেটেছে কোথায়?

মনির খান: ১৯৭২ সালের ১ আগষ্ট বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার মদনপুর নামক গ্রামে আামার জন্ম। আমার শৈশব-কৈশর সেখানেই কেটেছে।

সোনালীনিউজ: সঙ্গীত জগতে এলেন কীভাবে?

মনির খান: ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আকর্ষণ ছিল। এলাকার অনেক ওস্তাদের কাছে গান শিখেছি। তবে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় মূলত ওস্তাদ রেজা খসরুর কাছে। পরবর্তীতে স্বপন চক্রবর্তী, ইউনুস আলী মোল্লা, খন্দকার এনায়েত হোসেনসহ আরও কয়েকজন ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নিয়েছি। তবে সঙ্গীতের ভিত্তি গড়ে উঠেছে মূলত ওস্তাদ খন্দকার এনায়েত হোসেনের কাছেই।

প্রফেশনাল শিল্পী হিসেবে ১৯৮৯ সালে খুলনা রেডিওতে অডিশন দিয়ে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। ১৯৯১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এখান থেকে এন. ও. সি নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় এসে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছেও গান শিখেছি। এর মধ্যে রয়েছেন আবুবক্কার সিদ্দিক, মঙ্গল চন্দ্র বিশ্বাস, সালাউদ্দীন আহমেদ, অনুপ চক্রবর্তীসহ অনেক ওস্তাদ। ঢাকায় গান করতে এসে পরিচয় হয় জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার মিল্টন খন্দকারের সঙ্গে। সেখান থেকেই সঙ্গীতে আমার ভ্যাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে।

সোনালীনিউজ: মিল্টন খন্দকারের সঙ্গে পরিচয় হলো কিভাবে, মনে আছে?

মনির খান: তার গানের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। বলতে পারেন তার গানের ভক্ত ছিলাম। মনে মনে ভাবতাম কোনদিন যদি তার সঙ্গে দেখা করা যেত। একদিন বেতারের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলাম একজন মিল্টন ভাই বলে ডাক দিল। আমি বুঝে গেলাম এটাই মিল্টন ভাই। দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি বললেন, তুমি কে? পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমি ঢাকা এসেছি একটি অ্যালবাম করতে। তিনি বাসার ঠিকানা দিয়ে বাসায় যেতে বললেন।

সোনালীনিউজ: এরপর?

মনির খান: তাকে খুলে বললাম আমার বাবা স্কুল শিক্ষক। তিনি আমাকে একলাখ টাকা দিয়েছেন একটি অ্যালবাম করতে। আপনি সুযোগ দিলে অ্যালবামটি করতে চাই। তিনি আমার গান শুনলেন। গান শুনে বললেন, ভালো গাও কিছু বিষয় তোমাকে ঠিক করতে হবে। রাজি থাকলে তোমার অ্যালবাম করবো।

তোমার কোন টাকা লাগবে না। তুমি তোমার বাবার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আসো। আমি অবাক হয়েছিলাম তার কথা শুনে। এইতো তার কাছে আসা যাওয়া করতে থাকরাম। বিভিন্ন উচ্চারণসহ আমাকে সঙ্গীতের খুটিনাটি কাগজে নোট করে দিতেন। আমি পরেরদিন সেগুলো ইমপ্রুভ করে দেখাতাম। এভাবে করতে করতে আমার প্রথম অ্যালবাম ‘তোমার কোন দোষ নেই’ রিলিজ হলো। এই অ্যালবামটি আমাকে শিল্পী মনির খান হিসেবে চিনিয়েছে।

সোনালীনিউজ: এ পর্যন্ত আপনার গাওয়া অ্যালবাম ও মোট গানের সংখ্যা কত হবে?

মনির খান: বাজারে আমার ৪২টি অ্যালবাম ও সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০০ গান রয়েছে। এরমধ্যে সিনেমার গানই হবে ৫০০, অডিওতে ৩০০/৪০০, টেলিফিল্মে হবে ৫০টি, তাছাড়া রেডিও-টেলিভিশনে নিজের গাওয়া বেশ কিছু গান রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫০০ গান হবে।

সোনালীনিউজ: বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?

মনির খান: গান নিয়েই আছি। আগে অ্যালবামের জন্য দিনে ৫/৬টি গান করতাম। আর এখন দুই মাসে হলেও ১টি গান করছি। গানগুলি নিয়মিত আমার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করছি। গানের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠেও কিছু সময় ব্যয় করছি। সংসারে সময় দিচ্ছি। স্টেজ শো, চ্যানেলের ডাক তো আছেই। এসব মিলিয়ে ব্যস্ত।

সোনালীনিউজ: আপনার প্রত্যেকটি অ্যালবামে অঞ্জনাকে নিয়ে গান থাকে। অঞ্জনা বলতে কি ঘনিষ্ঠ আসলেই কেউ ছিল?

মনির খান: আমার ৪১টি অ্যালবামে অঞ্জনাকে নিয়ে ১টি করে গান করেছি। মানুষের জীবনে প্রেম ভালবাসা কার নেই? এরকম আমারও ছিল। অঞ্জনা তেমনি একজন। অঞ্জনা এখনও বেঁচে আছে। ও এখন বিদেশ থাকে। আমি তাকে এখনও মনে করি।

সোনালীনিউজ: অনেক দিল হল অ্যালবাম নেই বাজারে আপনার, কারণ কী?

মনির খান: আগের মতো এখন তো আর অ্যালবাম শোনে না মানুষ। তাছাড়া অ্যালবাম বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইরেসি হয়ে যায়। এতে পাইরেসি যারা করেন তারা লাভবান হয়। লোকসান গুনতে হয় যিনি অর্থলগ্নী করেন। পাইরেসি অ্যালবাম বলেন আর চলচ্চিত্র বলেন এদের মহামারি। এটাকে প্রতিরোধ না করতে পারলে আমাদের চলচ্চিত্র বলেন, আর অডিও-ভিডিও, সিডি বলেন, সব ধ্বংস হয়ে যাবে।

সোনালীনিউজ: সিনেমার গানে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, আগের মত সিনেমার গানে আপনাকে দেখা যায় না কেন?

মনির খান: এ পর্যন্ত আমি প্রায় ৫০০ সিনেমায় প্লেব্যাক করেছি। তিনবার জাতীয় জলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছি। এখন আগের মতো আর সিনেমা হয় না। আগে একটি সিনেমায় ৬/৮টি গান থাকতো। এখন সিনেমার নামে হয় টেলিফিল্ম। সেখানে ১/২টি গান থাকে। এগুলো নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা করেন। তাছাড়া সাড়াবছর শুধু মনির খান, এন্ড্রুকিশোররাই কি সিনেমার গান করবে। একসময় আমরা তরুণ ছিলাম, তাই করেছি। এখন যারা তরুণ মেধাবী তারা করছে। এখনও সিনেমায় ভালো গান হচ্ছে তবে সংখ্যায় কম। আমি এখনও সিনেমায় গান করছি তবে সংখ্যা কম।

সোনালীনিউজ:  মনির ভাই, সিনেমা বলেন আর আধুনিক গানই বলেন, আগের মতো কোন গান স্থায়ী হচ্ছে না। আপনার মন্তব্য কী?

মনির খান: গান স্থায়ী হওয়ার না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ শিল্পীদের অস্থিরতা। রাতারাতি তারকা হওয়ার প্রবনতা, ছোট একটি রুমের মধ্যে নিজে গান লিখেন, নিজে সুর করেন, নিজে কম্পোজিশন করেন, আবার ওই গান নিজে একাই শোনেন। তা হলে গান স্থায়ী হবে কি করে? ভালো গান করতে হলে, সমন্বয় দরকার, সেটা নেই। গানকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে হলে গানের কথা, সুর, কম্পোজিশন, সু-মধুর গায়কীর সমন্বয় থাকতে হবে। তবেই গান স্থায়ী হবে, মানুষ ওই গান দীর্ঘদিন শুনবে। এর জন্য তরুণদের মজবুত ফাউন্ডেশন দরকার।

সোনালীনিউজ: বিরহের গানে আপনি মানুষ কাঁদিয়েছেন, কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?

মনির খান: গানের কথা যদি মানুষের জীনের সঙ্গে মিলে যায়, সুরটি যদি কথার সঙ্গে মানায় পাশাপাশি মিউজিক কম্পোজিশন সামঞ্জস্য হয় তবেই শ্রোতাদের মনে গান গেঁথে যায়। মানুষ জীবনের সঙ্গে কথার মিল পেলে তখন গান শুনে কাঁদে। আমার প্রায় সব গানই দেখেবেন বাস্তবতার নিরিখে। গানের সৃষ্টির পেছনে একটা গল্প থাকে।

সোনালীনিউজ কার্যালয়ে কণ্ঠশিল্পী মনির খান

সোনালীনিউজ: আজকের মনির খান হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?

মনির খান: আজকের মনির খান হওয়ার পেছনে আমার বাবার অবদান রয়েছে। পাশপাশি সঙ্গীতে যিনি আমাকে নবজন্ম দান করেছে তিনি হলে শ্রদ্ধেয় ‘মিল্টন খন্দকার’। তিনি আমার সঙ্গীতের পিতা। তার জন্ম না হলে মনির খান হয়তো আজকের মনির খান হতো না।

সোনালীনিউজ: এ প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য আপনার পরামর্শ?

মনির খান: আমি আগেও বলেছি, গান গেয়ে টিকে থাকতে হলে মজবুত ফাউন্ডেশন দরকার। গানের চর্চা করতে হবে।

সোনালীনিউজ: সঙ্গীতে রিয়েলিটি শোর ভালো-মন্দ নিয়ে বলেন?

মনির খান: রিয়েলিটি শোর ভালো দিক হলো গ্রাম-গঞ্জ থেকে নানা সঙ্গীতের সম্ভাবনাময়ী নতুন ছেলে-মেয়েরা বের হয়ে আসছে। তারা ভালো গাইছে। তারা মেধাবী। সমস্যা হলো, তারা সঙ্গীতাঙ্গনে বেশিদিন টিকে থাকতে পারছে না। তারা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।

কারণ তাদের গোড়া মজবুত না। যে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তারা দীর্ঘপথ অতিক্রম করবে সেটি শক্ত নয়। তারা ভিত শক্ত না করে টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। রিয়েলিটি শোর আয়োজকরা ফ্ল্যাট, গাড়ি, নগদ অর্ধ, বিদেশে শো দিয়ে তাদের নষ্ট করে দিচ্ছে। আয়োজকদের উচিত তাদের ফাউন্ডেশন তৈরি করে দেয়া। যেখান থেকে তারা দীর্ঘপথ অতিক্রম করবে।

সোনালীনিউজ কার্যালয়ে কণ্ঠশিল্পী মনির খান

সোনালীনিউজ: আগামীর ভাবনা কী?

মনির খান: গান নিয়ে আছি। গানই আমার ধ্যানে-জ্ঞানে। গানের মাধ্যমেই আমি আজ মনির খান। গান নিয়েই ভাবতে চাই। রাজনীতিতে থাকলেও আমার পুরোটা হৃদয় জুড়ে আছে গান।

সোনালীনিউজ: আপনার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বলেন?

মনির খান: পারিবারিক জীবনে আমরা ৪ ভাই ১ বোন। বাবা-মা দুজনেই বেঁচে আছেন। বাবা শিক্ষক ছিলেন আর মা গৃহিনী। বাবার বয়স ৯০ বছরের বেশি হবে। ইনশাআল্লাহ এখনও ভালোভাবেই চলাফেরা করতে পারে। আমার ঘরে এক মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। মেয়েটির নাম মৌনতা, ছেলের নাম মুহূর্ত। দুজনেই পড়া-লেখা করছে। ব্যক্তি জীবনে আমি ভীষণ ভালো একজন মানুষ। নিজের ঢোল পেটাচ্ছি না। স্ত্রীর কাছে আমি একজন ভালো স্বামী, ভাইবোনদের কাছে ভালো ভাই। ভক্তদের কাছে প্রিয় শিল্পী, মা-বাবার কাছে প্রিয় ছেলে, রাজনীতি ও এলাকার মানুষে কাছে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। এটাও আমর বড় প্রাপ্তি।

সোনালীনিউজ: রাজনীতিতে কীভাবে এলেন?

মনির খান: ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্রদল করতাম। কলেজ জীবনে ছাত্রনেতা ছিলাম। ঢাকায় গান করতে এসে প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাযহারুল আনোয়ারের সঙ্গে সখ্যতা তিনি আমাকে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে নিয়ে যান। মেডাম আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমার গানের উৎসাহ দেন। নিজের ছেলের মতো দলের হয়ে সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যেতে কাজ করতে বলেন। এইতো দলের হয়ে কাজ শুরু করি। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছি।

সোনালীনিউজ: শুনেছি নিজ এলাকা থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করবেন, দলীয় মনোনয়নের গ্রিন সিগনাল পেয়েছেন?

মনির খান: মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর দুই উপজেলার বিপুলসংখ্যক বিএনপি সমর্থক ও নেতাকর্মীরা আমাকে শিল্পী হিসেবে পছন্দ করেন। তাদের আহ্বানে রাজনীতিতে এসেছি। তারা চায় আমি নির্বাচন করি। তাছাড়া আমার এলাকায় দলীয় কোনো কোন্দল নেই। সবাই আমার পক্ষে আছেন। আশাকরি নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/বিএইচ/জেএ

Wordbridge School
Link copied!