• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
অর্থ যোগানদারের পালা শেষ

আলবদর নেতা মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৬, ১০:৪১ পিএম
আলবদর নেতা মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর

একাত্তরের ঘাতক, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর শেষ রক্ষা হলো না। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেই হলো জামায়াতের অর্থের জোগানদার এই ধনকুবেরকে। শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃতুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ফাঁসি কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, ডিআইজি (প্রিজন), সিভিল সার্জন, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তারসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।

এদিকে ফাঁসি কার্যকরের আগে থেকে গাজীপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কারাগারের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় তারা মীর কাসেমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। একই সঙ্গে ফাঁসি কার্যকরের পর তারা আনন্দ করেন।

এদিকে মীর কাসেম হলেন প্রথম কোনো অপরাধী, যার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলো কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের। মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়া। তাকে সহযোগিতা করেন দ্বীন ইসলাম, শাহীন ও রিপন। এর আগে শনিবার বিকেলে তারা কারাগারের ভেতরে ফাঁসির মঞ্চে চূড়ান্ত মহড়ায় অংশ নেন। মোম মাখানো দড়িতে মীর কাসেমের আনুমানিক ওজনের সমান বালির বস্তা বেঁধে মহড়া দেয়া হয়। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবারও তারা ফাঁসির মহড়া দেন।

কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, শনিবার মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলম, সিভিল সার্জন হায়দার আলী খান ও পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ কারাগারে আসেন। সিভিল সার্জন মীর কাসেমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। মীর কাসেমকে তওবা পড়ান কাশিমপুর কারা জামে মসজিদের ইমাম মুফতি হেলাল উদ্দীন। এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে একাত্তরের ঘাতক মীর কাসেমের গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেন জল্লাদ শাহজাহান ও তার সহযোগীরা।

প্রায় ৫০টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে এরই মধ্যে আলোচিত জল্লাদ বনে গেছেন শাহজাহান। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এর আগেও একাধিক জামায়াত নেতার ফাঁসির রশিতে টান দিয়েছেন তিনি।  

এর আগে ফাঁসি কার্যকরের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কারাবিধি অনুযায়ী স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন এবং কারা মহাপরিদর্শকের কাছে অবহিতকরণ চিঠি পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। একই চিঠি পাঠানো হয় মীর কাসেমের গ্রামের বাড়িতে। কারাগারে পৌঁছে যান জল্লাদরাও। লাল খামে ভরে সকাল ১১টায় বিশেষ কারা বার্তাবাহকের মাধ্যমে এই চিঠি পাঠানো হয়।

মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ শনিবার দুপুরে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছে। এরপর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করার জন্য তার স্বজনদের খবর দেয়া হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছয়টি মাইক্রোবাসে করে মীর কাসেমের স্ত্রী, মেয়ে, পুত্রবধূসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনরাসহ মোট ৪৫ জন কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জনকে কাসেমের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। মীর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করে সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে তারা যখন বেরিয়ে আসেন, গাজীপুরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। কারা ফটক থেকে বের হওয়ার পরপরই গাড়িতে উঠে চলে যান তারা।

মীর কাসেমের স্ত্রী আয়েশা খাতুন জানান, মীর কাসেমের ভাই মানিকগঞ্জে একটি জমি কিনে রেখেছিলেন। সেখানেই তাকে দাফন করা হবে। এর প্রায় আধা ঘন্টা পর কারাগারে আসেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন।

মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই কারাগার ও আশপাশের এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। অতিরিক্ত জেলা হাকিম রাহিনুল ইসলাম জানান, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রবিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এই লাল সতর্কতা বহাল থাকবে।

এই লাল সতর্কতার অংশ হিসেবে চার প্লাটুন বর্ডার গার্ড বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে কারা ফটক ও এর আশপাশের এলাকাসহ পুরো গাজীপুরে। সন্ধ্যা থেকেই তারা গাজীপুরজুড়ে টহল দিতে শুরু করে। বিজিবি সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মোহসিন রেজা জানান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের চাহিদা অনুসারে বিজিবি সদস্যদের পাঠানো হয়েছে।

এর আগে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে কারারক্ষীদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র‌্যাব সদস্যদেরও। তিনটি গাড়িতে করে এসে র‌্যাব সদস্যরা কারাগারের আরপি গেটের (চার কারাগারের মূল ফটক) সামনে অবস্থান নেন।

দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তরে রয়েছেন কারারক্ষীরা। কারাগারে প্রবেশের আগে রাস্তার মুখে সমদূরত্বে তৈরি করা হয়েছে দু’টি পুলিশ বেষ্টনীও (ব্লক রেড)। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে কারাগারে ঢোকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। পুলিশের একটি জলকামান আগের রাতেই কারাগারের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। কারাগারের আরপি চেকপোস্টসংলগ্ন দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। উৎসুক জনতা ভিড় করে কারা ফটকে। কারাগারের আশপাশের বহুতল ভবনগুলোর ছাদে অবস্থান নেয় পুলিশ।

এ ছাড়া শনিবার সকাল থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য কাশিমপুর কারাগারের সড়কে এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। সেই সঙ্গে রয়েছেন কমিউনিটি পুলিশের সদস্যরা।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ জানান, শুধু কাশিমপুর এলাকা নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরো গাজীপুর জেলায় নেয়া হয়েছে। এ জন্য টঙ্গী, স্টেশন রোড, বোর্ডবাজার, ভোগড়া বাইপাস মোড়, চান্দনা চৌরাস্তা, গাজীপুর শহর, রাজেন্দ্রপুর, কোনাবাড়ি ও চন্দ্রা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এসব এলাকায় সর্বাত্মক সতর্কতা বজায় রাখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক থেকে কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত সড়কের পাঁচটি স্থানে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়। পুলিশ সদস্যরা এসব চৌকিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি অবস্থান নেন র‌্যাব সদস্যরা। তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চৌকিগুলো পার হতে দেয়া হয় সাধারণ মানুষকে।

কারাগারের মূল ফটক থেকে অন্তত ১০০ গজ দূরে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য স্থান করে দেয়া হয়। সকাল থেকে বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যমকর্মী কারাগারের সামনে গিয়ে উপস্থিত হন।

গত মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন। ওই দিন বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ২৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। পরে এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত মঙ্গলবার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর রায়ের কপি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ওই দিনই তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়। লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হয়ে রাত পৌনে একটায় কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়। বুধবার সকালে কারা কর্তৃপক্ষ মীর কাসেম আলীকে রায় খারিজ এবং মৃত্যু পরোয়ানা শোনায়।

এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা পাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দুই দিন ধরে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। পরে গত শুক্রবার তিনি জানিয়ে দেন যে, তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।

শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়ার জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে মীর কাসেম আলী ক্ষমা চাইবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তবে তিনি শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তার নিখোঁজ ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম যেন তারা জানাজা পড়ান। এ সময় তাকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। একপর্যায়ে তিনি কাঁদতে শুরু করেন বলে জানান জেল সুপার প্রশান্ত বণিক।

মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে।

একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়। আপিলেও তা বহাল থাকে। এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, যার ফাঁসি কার্যকর করা হলো। এর আগে যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!