• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আ.লীগের শক্তিশালী প্রার্থীর বিপক্ষে বিএনপি-জামায়াতের টানাপড়েন


কুমিল্লা প্রতিনিধি আগস্ট ৬, ২০১৭, ০১:২৬ পিএম
আ.লীগের শক্তিশালী প্রার্থীর বিপক্ষে বিএনপি-জামায়াতের টানাপড়েন

কুমিল্লা : কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী আসনগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে কুমিল্লা-১১ সংসদীয় আসন। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই সংসদীয় আসন। এখানে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত প্রার্থী এই আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত এমপি, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক। এখানে দল এবং মহাজোট তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। কোথায়ও নেই কোনো গ্রুপিং।

অপর দিকে বৃহত্তর কুমিল্লার তিনটি জেলার মধ্যে এই চৌদ্দগ্রামেই রয়েছে জামায়াত ইসলামীর শক্তিশালী অবস্থান। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত এই আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করলেও বর্তমানে দলটির অবস্থা খুবই দুর্বল। আর এখানে বিএনপির সাধারণ কর্মী সমর্থক থাকলেও শুধু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলটি এখানে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এখানে যেমন সুদৃঢ় ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ঠিক বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবস্থান এখানে বিপরীতমুখী। জামায়াত-বিএনপির অন্তর্কোন্দল এখানে চরমে।

১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জহিরুল কাইয়ুম, ১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী কর্নেল (অব.) আনোয়ার হোসেন, ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এমপি হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এমপি হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী কাজী জাফর আহমেদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে আবারো এমপি হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপিদলীয় প্রার্থী সামসুদ্দিন আহমেদ। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখান থেকে এমপি নির্বাচিত হন বর্তমান রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে এখান থেকে এমপি হন জামায়াতদলীয় প্রার্থী ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে পর পর দুই বার এমপি নির্বাচিত হন বর্তমানে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক মুজিবুল হক মুজিব।

আওয়ামী লীগ : শুধু চৌদ্দগ্রাম উপজেলাতেই নয় গোটা কুমিল্লা জেলায় একজন পরিচ্ছন্ন, কর্মীবান্ধব এবং গরীবের কল্যাণকামী নেতা হিসেবে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের একটি সুপরিচিত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম এমপি নির্বাচিত হয়েই জাতীয় সংসদের হুইপ হন মুজিবুল হক।

২০০৮ সালে নির্বাচনে দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়ে আবারো হুইপ হন তিনি। ওই সময়েই তাকে করা হয় রেলপথ মন্ত্রী। ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে তিনি অতিরিক্ত হিসেবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের পর তিনি আবারো রেলপথমন্ত্রী হন। এমপি নির্বাচিত হয়ে এমনকি মন্ত্রী হওয়ার পরেও ব্যতিক্রম ছাড়া তিনি প্রতি সপ্তাহেই নিয়মিত এলাকায় আসছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন চৌদ্দগ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। তিনি নিজকে সব সময়ই কৃষকের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কুমিল্লার রাজনীতিতে একটি বিষয়ে প্রচলিত আছে যে, এমপি মুজিবুল হকই একমাত্র নেতা যে তার বাসার ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম এমনকি বেড রুমও রয়েছে কর্মীদের অবাধ যাতায়াত। কর্মীদের জন্য তার ভালোবাসা অকৃপণ। যার কারণে তাকে কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে অবহিত করা হয়। স্থানীয়ভাবে নিজ দলের বাইরেও একজন পরিচ্ছন্ন ও সংবেদনশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে।

আগামী নির্বাচনে দল এবং মহাজোটে মুজিবুল হকের কোনো প্রতিদ্বন্ধী নেই। তিনি একক প্রার্থী। সংসদীয় আসনের উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ১৩টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং অধিকাংশের বেশি কাউন্সিলর ও মোল্লাররা তার দলের এবং তার একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। স্থানীয় জনগণের মতে, মুজিবুল হক এমপি হয়ে যে কাজ করেছেন ইতিপূর্বে চৌদ্দগ্রামে আর কেউ এত কাজ করেননি। সুতরাং আগামী নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হলেও তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে এমপি নির্বাচিত হবেন বলে তার কর্মীদের ধারণা।

বিএনপি : ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জয়লাভ তো দূরের কথা কখনোই ন্যূনতম প্রতিদ্বন্ধিতাও গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। সাংগঠনিকভাবেও দলটি এখানে খুবই দুর্বল। উপজেলাজুড়ে দলটির অসংখ্য কর্মী-সমর্থক থাকলেও শুধু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বিএনপি কখনোই এখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গে জোট হওয়ার পর এখানে দলটির গোটা মেরুদন্ডটিই ভেঙে যায়। কারণ বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর ৬ জেলার মধ্যে একমাত্র এই চৌদ্দগ্রামেই জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান সবচেয়ে ভালো। যার কারণে জোটগত নির্বাচন হলে জামায়াত এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রার্থী হয়। ফলে যেহেতু নির্বাচন এলে জামায়াত জোটের হিসেবে আসনটি পাবে, এই বিবেচনায় এখানে বিএনপির কোনো নেতাই রাজনৈতিক বিনিয়োগ করতে রাজি নয়।

২০০১ সালে এখানে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এমপি হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেক দূরে ঠেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে বিএনপির মধ্যে। তবে বর্তমান উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদার নেতৃত্বে যে বিএনপি রয়েছে তাতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে চলেছে বলে জানা গেছে।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা দুই বার উপজেলা নির্বাচন করলেও তার কর্মীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল তার বিজয় জোর করে সিল দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কও ভালো নয়। তার স্পষ্ট বক্তব্য, আগামী নির্বাচনে এখানে আর জামায়াতকে ছাড় দেয়া হবে না। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতা কামরুল হুদার বক্তব্য, আগে চৌদ্দগ্রামে বিএনপি দুর্বল ছিল। ইনশাআল্লাহ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এখন চৌদ্দগ্রামে বিএনপি এককভাবেই জয়লাভ করার আশা করে।

একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সাজেদুর রহমান মোল্লা হিরণ। তিনিও আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন।

জামায়াত ইসলামী : চট্টগ্রাম বিভাগের ১৯টি জেলার মধ্যে ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত যে দুটি আসনে চারদলীয় জোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। অপরটি হল চট্টগ্রমের সাতকানিয়া।

এ ছাড়া এই বিভাগে আর কোথায়ও তাদের প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এখনো তৈরি হয়নি বলে খোদ তাদের নেতাকর্মীরাই জানান। এবারো কুমিল্লার এই চৌদ্দগ্রামেই তাদের আশা-ভরসা। তাদের প্রার্থীও চুড়ান্ত। এখান থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

উপজেলা জামায়াতের জোর দাবি, যদি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে একটি আসনেও যদি জামায়াত মনোনয়ন পায়, সেটা পাবে কুমিল্লা-১১ চৌদ্দগ্রাম। তাদের বক্তব্য, বর্তমান সরকারের আমলে হামলা, মামলা ও নানাবিধ নির্যাতনে পড়ে এলাকায় থাকতে পারছি না। ফলে সাংগঠনিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে সত্য কিন্তু নির্বাচন এলে জামায়াতই ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে।

জাতীয় পার্টি : চৌদ্দগ্রাম থেকে তিন তিন বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। তিনি ছিলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা। চৌদ্দগ্রামে মূলত জাতীয় পার্টি কাজী জাফর কেন্দ্রীক।

২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট কাজী জাফর আহমেদ মারা গেলে জাতীয় পার্টির (জাফর) চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এক ধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা ১১ চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন কাজী জাফরের মেয়ে জয়া আহমেদ ও জাপা নেতা কাজী মহিউদ্দিন দুলাল।

জানা গেছে, কাজী জাফর কন্যা জয়া আহমেদ ইতিমধ্যে নিজেকে গুছিয়ে পুরোপুরি বাবার রেখে যাওয়া দলের হাল ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, একই সঙ্গে চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হওয়ারও চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে, চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতায় আসতে হলে বিএনপি-জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে হবে নতুবা শক্তিশালী আওয়ামী লীগের এই প্রার্থীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না টানাপড়েনে থাকা বিএনপি-জামায়াত।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!