• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
ফিরে দেখা ২০১৬

আলোচিত-সমালোচিত ছিল মিতু-তনু হত্যা


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬, ১২:৪০ এএম
আলোচিত-সমালোচিত ছিল মিতু-তনু হত্যা

বিদায়ী বছরে সারা দেশে সংঘটিত হয়েছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা। বিভিন্ন কারণে এসব ঘটনা আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। এসব খুনের ঘটনার মধ্যে চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু, ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, হবিগঞ্জে  চার শিশু, নারায়ণগঞ্জে এক পরিবারের পাঁচজন এবং চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এ ছাড়া আলোচনায় এসেছে পুরোহিত ও সেবায়েত খুনের ঘটনা।

মিতু হত্যাকাণ্ড : ২০১৬ সালে আলোচিত খুনের ঘটনার অন্যতম চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড। বিদায়ী বছরের ৫ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে সন্তানকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে তিনি খুন হন। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। খোদ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর নিরাপত্তা না থাকায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। ঘটনা পরিক্রমায় এসপি বাবুল আক্তার চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করে। পরবর্তী সময়ে এদের মধ্যে দুইজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ মিতুর প্রধান খুনি এবং মামলার প্রধান আসামি মুসাকে চিহ্নিত করে। মুসা ছিল এসপি বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স। মুসা এখনো গ্রেফতার হয়নি।

রিশা হত্যা : উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর কাকরাইল ফুট ওভারব্রিজের ওপর খুন হয়। ওবায়দুর নামের এক বখাটে যুবক রিশাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পুলিশ ওবায়দুরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

তনু হত্যা :কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভেতরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সারা দেশে এবং সব মহলে  আলোচনার ঝড় তোলে। গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে বাসার পাশের একটি আখক্ষেত থেকে তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ ওঠে, তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তনুর লাশ উদ্ধারের পর দোষীদের শাস্তির দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়। ২১ মার্চ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে তার প্রথম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ওই দিন অজ্ঞাতদের আসামি করে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন তনুর বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসের কর্মী ইয়ার হোসেন। পরে তার গ্রামের বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের তনুর লাশ দাফন করা হয়।

৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৪ এপ্রিল দেয়া হয় প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে তনুকে হত্যা ও ধর্ষণের আলামত না থাকায় দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ফরেনসিক বিভাগ। এর মধ্যে ১৪ মে কুমিল্লার আদালতে তনুর ডিএনএ প্রতিবেদন দেয়া হয়। ১৬ মে তনুর কাপড়ে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যাওয়ার খবর সিআইডি থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আবারও আলোচনায় উঠে আসে প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ডিএনএ প্রতিবেদনের এমন গরমিল থাকায় তনু হত্যা মামলা সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।

গত ১২ জুন সিআইডির কাছে তনু হত্যার দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন ময়নাতদন্তকারী মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও মৃত্যুর কারণ পাওয়া যায়নি। তবে মৃত্যুর পূর্বে তনুর সঙ্গে ‘সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স’ হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন মিথ্যা বলে দাবি করেন তার মা আনোয়ারা বেগম।

অধ্যাপক রেজাউল হত্যা : ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে আন্দোলন শুরু করেন অধ্যাপক রেজাউলের সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা। অধ্যাপক রেজাউল হত্যার দিনই থানায় মামলা করেন তার ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ। এ মামলায় পুলিশ বিভিন্ন সময় অন্তত ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।

ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যা : বিদায়ী বছরের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২ নম্বর গেট এলাকায় একটি ভবন থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেলে দিয়াজের মা জোবায়দা আমিন চৌধুরী দাবি করেন, তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

লাশ উদ্ধারের পর দিয়াজের শরীরের তিন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফসানা বিলকিস। দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনায় ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দিয়াজের বড় বোন যোবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা মামলা দায়ের করেন। দিয়াজ ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। গত বছর তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকের পদ পান।

হবিগঞ্জে  ৪ শিশু হত্যা : বিদায়ী বছরে আলোচিত ঘটনার অন্যতম হবিগঞ্জে ৪ শিশু হত্যা। ১২ ফেব্রুয়ারি বাহুবল উপজেলার তন্দ্রাটিকি গ্রামে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। হত্যাকারীরা ওয়াহিদ মিয়ার পুত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই আব্দুল আজিজের পুত্র তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার পুত্র মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আব্দুল কাদিরের পুত্র ইসমাঈল হোসেনকে (১০) অপহরণ করে হত্যার পর বালিচাপা দিয়ে রাখে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মূলহোতা আব্দুল আলী বাঘালসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর মধ্যে হবিগঞ্জ কারাগারে আছেন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল আলী বাঘাল, তার দুই ছেলে জুয়েল ও রুবেল, একই গ্রামের আজিজুর রহমান আরজু এবং শাহেদ আলী। পলাতক ৩ আসামি হলেন- আব্দুল আলী বাঘালের ভাতিজা অটোরিকশাচালক বিল্লাল হোসেন, উস্তার মিয়া ও বাবুল আহমেদ। মামলার অন্যতম আসামি অটোরিকশাচালক বাচ্চু র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

নারায়ণগঞ্জে এক পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা : ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইল এলাকায় এক পরিবারের পাঁচজন খুন হন। পারিবারিক দ্বন্দ ও এক নারীর প্রতি আসক্তির জের ধরে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত পাঁচজন হলেন- মোরশেদ, তার বোন তাসলিমা এবং তাসলিমার দুই সন্তান শান্ত ও সুমাইয়া, তাসলিমার দেবরের স্ত্রী লামিয়া। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চরবেলাবোয়। নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলে তারা ভাড়া থাকতেন।

এ ঘটনায় নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামানের আদালতে মাহফুজ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মাহফুজ একাই পাঁচজনকে হত্যা করে বলে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন।

পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যা : এ বছর দুর্বৃত্তরা মঠ ও গির্জার পুরোহিত ও সেবায়েতদের হত্যা করে। এদের মধ্যে পাবনায় সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে, ঝিনাইদহে সেবায়েত আনন্দ গোপাল, সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস, পঞ্চগড়ে মঠের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায় ও নাটোরের খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকে হত্যা করা হয়।

পাবনায় সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে হত্যা : বছরের অলোচিত হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ছিল পাবনার হেমায়েতপুরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে হত্যার ঘটনা। হত্যার পর সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইটে এ হত্যার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট (আইএস)।

ঝিনাইদহে সেবায়েত আনন্দ গোপাল : ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহিষাডাঙ্গা এলাকায় আনন্দ গোপালকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি করাতিপাড়া গ্রামের সত্যগোপাল গাঙ্গুলীর ছেলে। তিনি নলডাঙ্গা সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত। এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আইএস।

ঝিনাইদহে সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যা : ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল হত্যাকাণ্ডের ২৩ দিনের মাথায় ৩০ জুন খুন হন সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস। একইভাবে এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ইসলামী স্টেট (আইএস)।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সন্ত গৌরীর মঠের প্রধান পুরোহিত অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায় খুন হন। ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন পুরোহিতকে হত্যার দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)।

নাটোরের বনপাড়ায় খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনিল গোমেজ খুন হন ৫ জুন। বনপাড়ায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ঘটনার পর দায় স্বীকার করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে এ খবর প্রকাশ করে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!