• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আশা জাগাচ্ছে না পর্যটন খাত


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এপ্রিল ২২, ২০১৭, ০১:১৯ পিএম
আশা জাগাচ্ছে না পর্যটন খাত

ঢাকা: বাংলার জমিনে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত-শত নদী। এসব নদীর অববাহিকায় নয়ন জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। জনপদে হৃদয় নিংড়ানো অতিথি পরায়ণ মানুষ। প্রকৃতির পাশাপাশি এসব মানুষ বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুকাল আগে থেকেই।

এক সময়ে শুধু জাপান ও চীন থেকে পর্যটকরা এদেশে আসতেন বাংলার মানুষের জীবন-জাবিকা, পারিবারিক বন্ধন ও ঐতিহ্য জানার জন্য। ঘুরে বেড়াতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল দেশের পর্যটন খাত। 

তবে বিদেশিদের সেই টানে এখন ভাটা পড়েছে। এখন দেশে যে পরিমাণ বিদেশি আসছে তার সিংহভাগই সরকারি বা বেসকরারি কোম্পানি ও ব্যবসায়িক কাজে। ফলে পর্যটন বিকাশ হচ্ছে না। 

পর্যটনের এ করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে বিভিন্ন দেশে পর্যটন নিয়ে কাজ করে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে। সেখানে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের তালিকায় পর্যটন খাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫। তালিকায় যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত ও জঙ্গি হামলায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দেশ পাকিস্তানও রয়েছে বাংলাদেশের ওপরে।

বাংলাদেশের পর্যটন খাত নিয়ে এমন হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগিতা সূচক ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। পর্যটক আকর্ষণে একটি দেশ কতটা নিরাপদ, অবকাঠামো সুবিধা কেমন, বিমানবন্দর কতটা উন্নত, আবাসন ব্যবস্থার মান কেমন— মোটা দাগে এমন ১৪টি বিষয় বা সূচকের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। 

এই তথ্যর সঙ্গে দেশের পর্যটন নিয়ে বেরসকারিভাবে কাজ করে ট্যুর অপারেটরস অব বাংলাদেশ (টোয়াব) একমত হলেও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে পর্যটন বাড়ছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিটি দেশকে কয়েকটি খাতের ব্যবস্থাপনার ওপর সর্বোচ্চ নম্বর দেয়া ছিল৭, আর সর্বনিম্ন নম্বর ১। সবগুলোর গড় নিয়ে একটি সার্বিক অবস্থান প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতি দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৭। 

প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলাদেশ থেকে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাংলাদেশে ব্যবসা আছে ও ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে, এমন দেশি-বিদেশি ৮৭টি কোম্পানির নির্বাহীদের মতামত নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করার মতো অবকাঠামো সুবিধা নেই বাংলাদেশে। এমনকি পর্যটন আকর্ষণ করার কোনো নীতিমালাও নেই সরকারের। 

পর্যটক আকর্ষণে বর্তমানে বিশ্বের ১ নম্বর দেশ হলো স্পেন। দেশটির স্কোর হলো ৫.৪৩। আর ১২৫ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ২.৯। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও কানাডা। পর্যটক আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভারত। তালিকায় দেশটি আছে ৪০ নম্বরে। এ ছাড়া ভুটান ৭৮ নম্বরে, নেপাল ১০৩ ও পাকিস্তান আছে ১২৪ নম্বরে।

বাংলাদেশের ব্যাপারে দেয়া তথ্যর মধ্যে পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ ১৩৩ নম্বরে। পর্যটকদের আবাসন বা হোটেলের মান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। এ সূচকে বাংলাদেশ আছে ১৩৫ নম্বরে। বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে ভাড়া গাড়ির সেবার দুরবস্থার বিষয়টিও এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সূচকে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১২৯ নম্বরে। 

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পের প্রসারের বিষয়টিও বাংলাদেশে কম গুরুত্বপূর্ণ। এ সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ১২৭। সরকারের অগ্রাধিকার খাত সূচকে বাংলাদেশ আছে ১১১ নম্বরে। অর্থাৎ পর্যটন খাতের উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণা, তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ, ব্র্যান্ডিংয়ের মতো সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ থেকে ১৩০-এর মধ্যে।

বাংলাদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সূচকে বাংলাদেশ আছে ১২৩ নম্বরে। বাংলাদেশে পুলিশের সেবার বিশ্বস্ততার বিষয়টিও নিরাপত্তা সূচকে উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আছে ১১৭ নম্বরে। অর্থাৎ পুলিশের সাহায্য নেয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকেরা খুব একটা আস্থাশীল নন।

বাংলাদেশে পর্যটন নিয়ে কাজ করে একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটরের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, পর্যটন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই মন্ত্রণালয়ের। এমন কিছু অহেতুক খরচ করছে মন্ত্রণালয়, যার কোনো লাভ নেই। এতে পর্যটনের বিকাশ হবে না। এ খাতের বিকাশে পর্যটন নিয়ে কাজ করে ট্যুর অপারেটরদের নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দিলে খাতের বিকাশ হবে। গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরে বিদেশি পর্যটক কমে গিয়েছে তিন-চতুর্থাংশ।

এখন নিরাপত্তা শঙ্কার সেই পরিবেশ নেই। কিন্তু সরকারিভাবে তেমন প্রচার হচ্ছে না। এখন মূলত অভ্যন্তরীণ পর্যটনের ওপর ভর করে টিকে আছে আমাদের ব্যবসা- বলে উল্লেখ করেন তিনি।

চোখ বুজে আসার মতো সৌন্দর্য

তবে, দেশের বেসরকারি  ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি তৌফিক উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, বহির্বিশ্বে পর্যটনশিল্পের প্রচারণা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের তেমন কোনো বাজেট নেই। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এমনকি ভারতের পর্যটনবিষয়ক অসংখ্য বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনো বিজ্ঞাপন নেই। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর লাগেজ ফেরত পেতে এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগে। এভাবে চললে বাংলাদেশের পর্যটন খাত কখনোই বিকশিত হবে না।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৫ লাখের বেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছেন। আগের বছরে যা ছিল সাড়ে ৪ লাখের মতো। প্রতিবেশী দেশ নেপালে একই সময়ে পর্যটক এসেছেন ৭ লাখ ২৯ হাজার, ভারতে একই সময়ে পর্যটক এসেছেন প্রায় ৯০ লাখ। 

তবে, এই হিসাবের সঙ্গে একমত নন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সরকারি, উন্নয়ন সংস্থা ও কোম্পানির কাজে যারা দেশে আসেন তারা তো পর্যটক নন। তাদের দিয়ে পর্যটন খাত বিকাশ হবে না। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব

Wordbridge School
Link copied!