• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহারে বাচ্চু তোর এইসব স্মৃতির ভার আমি আর বইতে পারছি না


কুমার বিশ্বজিৎ অক্টোবর ২৩, ২০১৮, ০৩:৪১ পিএম
আহারে বাচ্চু তোর এইসব স্মৃতির ভার আমি আর বইতে পারছি না

আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে কুমার বিশ্বজিতের লেখা থেকে নেওয়া-

“খুব মনে পড়ে। আমরা দুজন প্রথম ঢাকায় আসলাম ৭৮-৭৯ এর দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) হোটেলের পাশে সাকুরা বারে আমরা অডিশন দিতে আসলাম। মানে পরীক্ষায় পাশ করলে এই বারে নিয়মিত বাজানোর সুযোগ হবে।

ঢাকায় এসে উঠলাম বাসাবোর একটা হোটেলে। দুই দিন গেল, তারপরও অডিশনে ডাকে না।দুজনের পকেট ফাঁকা। পরিবার থেকে তো ‘না’ বলে আসছি। এরপর এক রাতে হোটেলে বসে বাচ্চুকে বললাম, তোর পকেটে কত আছে?

বললো- ৫ টাকা। আমার পকেটে হাত দিয়ে পেলাম ১০ টাকা। বললাম, তাইলে আমরা চট্টগ্রাম ফিরে যাবো ক্যামনে? বাচ্চু তো আবার বেশ মজার লোক। সে আমার এই টেনশনের কোনও পাত্তাই দিলো না।

সে আবার বেশ ভোজন রসিক ছিল। বলে, ‘আগে খাইয়া নিই বেটা। পরে অন্য হিসাব।’ আমি পরে ডাক দিলাম বেয়ারাকে। বললাম, আচ্ছা কমের মধ্যে কী আছে নাস্তা (ডিনার)। বললো, পরটা আর ভাজি আছে। বললাম, দুইটা পরোটা আর একটা ভাজি নিয়ে আসো। বেয়ারা আনলো। তখন আবার এগুলা খবরের কাগজে মোড়ায়ে দিতো।

দুই পরটা একটা পেপারে। আরেকটা পেপারের টুকরায় ভাজি। বেয়ারা আমাদের রুমে আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাজির পেপার ভিজে ধপাস করে হোটেল রুমের ফ্লোরে পড়ে গেল! আমি তখন বললাম, বাচ্চু রুটি-ভাজিও তোর কপালে নাই। কী আর করা। পানি খেয়ে শুয়ে পড়। বাচ্চু বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললো, আরে রাখ তোর কপাল।

এই বলে সে ফ্লোর থেকে ভাজিটা তুলে নিলো আরেকটা কাগজে। এরপর দুজনে সেটা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। আহারে বাচ্চু… তোর এইসব স্মৃতির ভার আমি আর বইতে পারছি না।

বাচ্চুর নিথর দেহ হাসপাতালে ফেলে এসে বাসায় ফিরে এসব ভাবি আর মনে হয়, আজকের ছেলেরা যে মসৃণ একটা পথ পেয়েছে সেটা এই বাচ্চুদের ঘামের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে।

এই কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই। এমন হাজার হাজার কষ্টের ঘটনা আছে আমার আর বাচ্চুর। যা বলে শেষ করা যাবে না।

সংগীতের জন্য আমাদের দুই বন্ধুর দু’একটা কষ্টের ঘটনা না বলেও পারছি না। এসব বলতে চাইনি কখনও। না ও, না আমি। তবে এখন বোধহয় বলার সময় এসেছে। কারণ, আমি এসব বলে হালকা হতে চাই।

এত এত স্মৃতির ভার আমি একা একা আর বইতে পারছি না। মনে পড়ে, তখন আমাদের একমাত্র মিউজিক করার ক্ষেত্র ছিল বিয়ে বাড়ি। ২০/৩০টা বাস ভরে মেহমান আসতো বিয়ে বাড়িতে। তাদের তো ঘুমানোর জায়গা দিতে পারতো না। তাই আমাদের গান দিয়ে অতিথিদের জাগিয়ে রাখতে হতো।

আমরা টানা গাইতাম আগের দিন সন্ধ্যা ৮টা থেকে পরেরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত! এরমধ্যে হয়তো যার বিয়ে তার শ্বশুর বলেছে মোহাম্মদ রফির গান করার জন্য। আবার কেউ হয়তো আবদার করলো ‘মান্না দে’ গাইবার জন্য। যা বলছে যেমনে বলছে তাই আমাদের গাইতে হতো। একবার এমন একটা অনুরোধ রাখিনি আমরা।

ভুলে গিয়েছি হয় তো। সকালে আমাদের ইনস্ট্রুমেন্টস গুছাতে গুছাতে বললাম- ভাই আমাদের পারিশ্রমিক? জামাই বললো, আপনারা তো আমার আব্বার অনুরোধের গানটা পরিবেশন করেন নাই। সরি ভাই, আপনাদের জিনিস-পত্র (গিটার-কিবোর্ড-ড্রামস) দিতে পারবো না। আপনারা চলে যান।

পরে ওসব ফেলে রিক্সা ভাড়া করে গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসি খালি হাতে। এই যে কষ্টগুলো। এই করুণ কাহিনি আমাদের জীবনে এসেছে। আরেকটা বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা বলে শেষ করি। দুই বন্ধু মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলাম। বেশ ফুরফুরে মেজাজ আমাদের। হঠাৎ দেখলাম একজন দা হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে!

আমরা সব ফেলে দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে তাকেই বললাম, ভাই কী হয়েছে? পেছন থেকে ঐ লোক বললো, আব্বা নামাজি মানুষ। উনি বলছে গান বাজনা হারাম। তোদেরকে আনছে কে। আজকে তোদের জবাই করে ফেলবো। ইত্যাদি। সঙ্গে গালাগালি তো আছেই। এই কথা শুনে বাচ্চু একদিকে দৌড়াচ্ছে আমি আরেক দিকে।

পায়ে একজনেরও স্যান্ডেল নাই। এরমধ্যে এই দৌড়ের সঙ্গে পেছনে যুক্ত হয়েছে বাড়ির দুই তিনটা কুকুরও। শেষ সম্বল ইন্সট্রুমেন্টও ফেলে এসেছি। মিউজিকের জন্য এই যে কষ্ট, এই যে বাঁচার দৌড়- সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় আমার বন্ধুটি ফার্স্ট হয়ে গেল আজ। বাচ্চু ছাড়া আমি একা, বন্ধুহীন, পরাজিত একজন। থেমে গেল আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতা।”


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!