ঢাকা : ২০১০ সালের ডিসেম্বরের কথা। মা’সহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বগুড়ার বাম্বি হলে গিয়েছিলাম লালন ফকিরের জীবনভিত্তিক সিনেমা ‘মনের মানুষ’ দেখতে। ভারতের নামী পরিচালক গৌতম ঘোষ এ ছবির কাহিনী নিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস থেকে। ছবিতে ‘আদি’ লালন ফকিরকে যেন খুঁজে পাওয়া গেল প্রসেনজিতের মধ্যে। আমার লালনভক্ত মা যারপর নাই মুগ্ধ হলেন, খুশি হলেন।
তবে ভ্রু কোঁচকালো আমার ছোট বোন। তাতে মা-ও সমর্থন দিলেন। তাদের যুক্তি, ছবিতে যে বলতে চাওয়া হয়েছে বসন্ত রোগে আক্রান্ত লালন ওপার (ভারত) থেকে ভেসে এসেছে কালীগঙ্গা নদীতে, তারপর তাকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে উদ্ধার করা হয়- সে ঘটনা মোটেই সত্য নয়। মা আর বোন জোর দিয়ে বললেন, ‘লালনের জন্ম আমাদের এ মাটিতেই, ওপারে নয়। আর এটাই বড় সত্য’।
অবশ্য এ নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দিকে আঙ্গুল তোলা যায় না। কারণ তিনি বলেই দিয়েছেন, ‘মনের মানুষ উপন্যাসটি লালন ফকিরের প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনি হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না। কারণ তাঁর জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়।’ তবে লালনের প্রতি আমার মায়ের অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভক্তির আবারো প্রমাণ পেলাম মনের মানুষ দেখাতে নিয়ে এসে।
প্রসঙ্গটির অবতারণ এজন্যে যে, বলিউডের প্রভাবশালী নির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘পদ্মবতী’ সিনেমা নিয়ে ভারতের রাজস্থানসহ কয়েকটি রাজ্যে উত্তাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। শেষ অবধি বিগবাজেটের এই ছবির মুক্তির তারিখও বাতিল হয়েছে।
রাজস্থানের করনি সেনা ও উত্তর প্রদেশের ক্ষত্রিয় সমাজসহ কয়েকটি মহল এ ছবির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের দাবি, ‘পদ্মবতী’ সিনেমায় ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। অভিযোগ, ছবিতে হিন্দুধর্মের অবমাননা, রাজপুত নারী আর রানী পদ্মিনীর সম্মানহানি করা হয়েছে। শুধু ছবি মুক্তির প্রতিবাদই করেনি বিক্ষোভকারীরা, তারা রীতিমতো, পদ্মিনী চরিত্রে রূপদানকারী দীপিকার মাথার মূল্য নির্ধারণও করেছে।
যারা হিন্দি ছবির ভক্ত, আমি নিশ্চিত, তারা কয়েক দফা করে দেখেছেন সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘হাম দিল দে চুকে সনম (১৯৯৯)’, ‘দেবদাস (২০০২)’, ‘ব্ল্যাক (২০০৫)’, ‘বাজিরাও মাস্তানি (২০১৫)’ সিনেমাগুলো। প্রখ্যাত এই পরিচালকের বিগবাজেটের ‘পদ্মবতী’র মুক্তির অনিশ্চয়তা তাদের নিশ্চয়ই
ব্যথিত করবে, হতাশ করবে।
এটা ভাবতে অবাক লাগে যে, মানুষ সিনেমা হলের রূপালী পর্দায় প্রদর্শিত সিনেমায় মূলত নিজেকে, নিজের সমাজকে আর নিজের দেশকেই দেখতে চায়। তাও আবার বাস্তবিকই। তা যে কল্পনার তা সে বিশ্বাস করতে চায় না। কখনও কখনও এই কল্পনাই যেন বাস্তব হয়ে ওঠে।
ক’দিন আগে, ঢাকাই ছবি ‘রাজনীতি’তে সুপারহিরো শকিব খানের মোবাইল নাম্বার হিসেবে হবিগঞ্জের এক অটোরিকশাচালকের নাম্বার ব্যবহার করার ঘটনা নিয়ে দেশে তোলপাড় হয়েছে। শেষ অবধি ছবির পারিচালকসহ নায়ক শকিব খানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই অটোরিকশা চালক। ঘটনাটি নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় খবরও প্রকাশ হয়েছে।
আজ থেকে বহুদিন আগে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের আলোচিত ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর একটি ঘটনা নিয়ে গোটা দেশে তোলপাড় হয়েছিল। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘বাকের ভাই’এর ‘বিনাদোষে’ ফাঁসির রায় ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশের তরুণ-তরুণীরা রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। ওই ঘটনা অনেকেরই মনে আছে এখন।
গৌতম ঘোষ, সঞ্জয় লীলা কিংবা হুমায়ূন আহমেদ- যার কথাই বলি না কেন, দর্শক আসলে ছবিতে নিজেদেরই দেখতে চায়। সেটা হোক অতীত, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ। যে সিনেমা যতো জীবনমুখী সে সিনেমা ততো সফল।
এ ফাঁকে একটা ‘বিতর্কিত’ বিষয়ের পক্ষে ‘সাফাই গাওয়ার’ চেষ্টা করা যেতে পারে। অনেকদিন ধরেই আমরা ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শিত সিরিয়ালের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে আসছি। হুংকার দিয়ে বলছি, পারিবারিক ‘কূটক্যাচাল’নির্ভর ওইসব সিরিয়াল দেখে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের ‘বউঝি’রা। অবশ্য এ নিয়ে পারিবারিকসহ দাম্পত্যে বহু ঝামেলাও তৈরি হচ্ছে আমাদের। ওইসব সিরিয়ালের মধ্যদিয়ে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন হলো- আমাদের নির্মাতা সমাজের সদস্যরা কিন্তু এসব দর্শক ‘বউঝি’কে সরাসরি আক্রমণ করে বসছেন। বলতে কি, তারা এসব দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করছেন। অর্থাৎ, আমাদের নাটক ভারতের সিরিয়ালের চেয়েও অনেক ভালো মানের, তারপরেও কেন তারা এসব ‘ভালো’ ছেড়ে ওসব ‘খারাপের’ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে? এমন প্রশ্ন তুলছেন।
আমার মনে হয়, যারা এসব বলছেন আর রাগে ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়ছেন তারা একটা কাজ করতে পারেন- ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে যেসব তরুণ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছেন তাদের ভাড়া করতে পারেন। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দর্শকদের উচিত শিক্ষা দিয়ে আসবে। হুমকি দিয়ে আসবে- দেশের বাইরের কোনো সিরিয়ালে যেন তারা চোখ না রাখে। রাখলে চোখ উপড়ে ফেলবে তারা।
এমনটা করতে পারলে, এক সময় আমাদের দর্শক ‘বউঝি’রা প্রাণভয়ে এমনিতেই ওইসব সিরিয়াল দেখা ছেড়ে দেবে। আর আপনারা যারা ভারতীয় সিরিয়ালের চেয়ে ভালো মানের নাটক নির্মাণ করছেন তাদের নাটক দেখতে বাধ্য হবে!
আরেকটু ক্ষোভের কথা বলা যায়। আমাদের টিভিগুলোতে যেসব অনুষ্ঠান নির্মাতা আছেন, তারা কি দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় মাথায় রেখে অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন? আর সবচেয়ে বড় কথা তাদের যেসব পুতুল উপস্থাপক সেসব অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন তারা কি দর্শকবান্ধব? কখনও যদি কোনো অনুষ্ঠানের শুরুটা দেখতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনি কোনোভাবেই জানতে পারবেন না ওই অনুষ্ঠানের নাম, কারণ আর অতিথির নাম। কারণ উপস্থাপকরা মনে করেন, তাদের উপস্থাপিত অনুষ্ঠানটি দর্শককে শুরু থেকেই দেখতে হবে। না হলে তাদের করার কিছু নেই।
সত্য কথা বলতে কি, ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর শতকরা অন্তত ৭০ ভাগ অংশেই আমরা ভালোমন্দ মিশেলের সাধারণ আর স্বাভাবিক জীবনকে খুঁজে পাই। আর আমাদের নাটকগুলোতে শতভাগই খুঁজে পাই নাটক। যার চরিত্রগুলো কখনও মহৎ- অতিমানবীয় কখনও বাস্তবতাবর্জিত ভাঁড়। তাছাড়া আমাদের নাটকের শুরু কিংবা শেষের সময়টাও ‘নয়টার গাড়ি কয়টায় আসে- এমন সম্ভাবনাময়তার চক্রে আবর্তিত। এটাই বড় পার্থক্য ভারতীয় সিরিয়াল আর আমাদের ‘ভালোমানের’নাটকগুলোর।
ধানভানতে শীবের গীত গাওয়া হলো। শেষে একটাই প্রশ্ন- সিনেমা কি সমাজ ও জীবননির্ভর? নাকি জীবনই সিনেমানির্ভর? নাকি দুটোই সমপরিমাণে সত্য?
লেখক : সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :