• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতার দেশে দেশে


এম শামসুদদোহা তালুকদার জুন ২৭, ২০১৬, ০১:২৩ পিএম
ইফতার দেশে দেশে

ইফতারের সময় সে কী আনন্দ! দীর্ঘ উপসের পর খেতে পাওয়ার আনন্দ? না, এ হলো সারা দিন সঠিকভাবে আল্লাহর আদেশ পালন করতে পারায় যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, আল্লাহর মহব্বতে ক্ষুধা-তেষ্টার চরম পরীক্ষায় যে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে, তারই আনন্দের কূলফাটা জোয়ার রোজাদারের হৃদয়জুড়ে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেই সব রোজাদারের হৃদয়জুড়ে। বিশ্বের কোথায়, কীভাবে ইফতার করছেন রোজাদার মুসলমান, তা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

মহানবী (সা.) এর সময়ে পাকা খেজুর, খোরমা, ছাতু মিশ্রিত পানীয়, পানি সহযোগে ইফতার করার রেওয়াজ ছিল। যুগের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে ইসলামের জন্মভূমি মক্কা-মদিনাসহ সমগ্র আরব জাহানে ইফতার সামগ্রীতে বিপ্লবের ধারা চলছে। নানা প্রজাতির সুস্বাদু খেজুরের সঙ্গে ফলমূলকে প্রাধান্য দেয় তারা। মিষ্টি শরবত ফুলের জুস ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘খেবজা’ (ঘিয়ে ভাজা ভাত ও আস্ত দুম্বা বা খাসির রোস্ট), ‘খুবজ’ বা রুটি, ঝলসানো গোশত তাদের প্রিয় খাদ্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সাধারণত চিনি দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি হয় না। তবে বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস ও সুস্বাদু ডেজার্ট খুবই প্রচলিত। আরব দেশগুলোয় রমজানের প্রতিটি রাতই ঈদের উৎসবে মাতোয়ারা থাকে। ইফতার, খতম তারাবি শেষে ইবাদতের পাশাপাশি আরব বংশোদ্ভূতরা সাহরি পর্যন্ত জেগে থেকে প্রচুর আহার পর্বে ব্যস্ত থাকে। আর দিনের অধিকাংশ সময় বিশ্রামে কাটায়, অফিস-আদালতের সময়ও কমিয়ে দেয়া হয়, অনেকটা ঐচ্ছিক প্রকৃতির। মধ্যপ্রাচ্যের তথা বিশ্বসভ্যতার মাঝে বোধহয় সবচেয়ে হতভাগ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি মুসলিমরা। উষ্ণ আবহাওয়ার দেশটিতে দিনে রোজা রেখে  শরবত, খোরমা মুখে দেয়ার সুযোগ আর কই? সন্তান-স্বজন ও প্রিয় সহযোদ্ধাদের মাঝে কে হতাহত হতে যাচ্ছে, এ আশঙ্কা নিয়েই তো প্রতিটি রাত কাটায় গাজাবাসী।

ইরানিরা ইফতার সারে ‘গরম চা’ আর ‘নান’ (রুটি) দিয়ে। এছাড়া পনির, মিষ্টি খেজুর ও মিষ্টি হালুয়ারও প্রচলন রয়েছে। তুরস্কে ইফতার আয়োজনে আধুনিকতা লক্ষণীয়। মজাদার ইফতারের জন্য বিশেষ পদ ‘ইফতারিয়ে’ (ওভঃধৎরুব), যা এক ধরনের স্যুপ, রুটি শুধু রমজান উপলক্ষেই তারা তৈরি করে থাকে। এছাড়া খেজুর, অলিভ, মাখন ছাড়াও রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত ‘গুলাক’ (এঁষষধপ), যা গোলাপ পানি মিশ্রিত উপাদেয় ডেজার্ট। রমজানের রাতগুলোয় তারা জড়ো হয় স্থানীয় কোনো মিলনায়তনে সূরের মূর্ছনা উপভোগ করতে। অটোমান ক্লাসিক, ঐতিহ্যবাহী তার্কিশ ও সুফি মিউজিকের প্রচ- গুণগ্রাহী তুর্কিরা।

আফগানরা বেলা শেষে রোজার সমাপ্তি ঘটায় ঐতিহ্যবাহী ‘সুরবা’ নামে এক ধরনের স্যুপ মুখে দিয়ে। খেজুর, কাবাব, গোশতের দোপিয়াজা, আর ‘মানতো’ নামে পেস্তা বাদাম ও কষানো গোশত দিয়ে সুস্বাদু খাবার গ্রহণ করে আফগান মুসলিমরা। আর প্রসিদ্ধ কাবুলি পোলাও, মিষ্টি ও ডেজার্ট তাদের রাতের আহারের মেন্যুতে থাকা চাই। আফ্রিকার আলজেরিয়ার মুসলিমরা ইফতার সারে ‘জালাবিয়া’ নামক মিষ্টান্ন দিয়ে। এটি তাদের রমজানের ঐতিহ্যবাহী ইফতার মেন্যু। তারা এ মাসটিতে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে একে অপরের সঙ্গে। ‘বাহামা’ নামক খাবারঘরে স্থানীয়রা জড়ো হয় ইফতার ও সাহরির উদ্দেশ্যে।

পাকিস্তানিদের প্রিয় জিলাপি, সমুচা, পাকোরা আর হামদর্দের বিশ্ববিখ্যাত ‘রুহ আফজা’ সংমিশ্রিত শরবত। সচ্ছলরা ইফতারিতে চিকেন রোল, স্প্রিং রোল, শামি কাবাব আর সালাদ খেয়ে থাকে। ফলও তাদের প্রিয় খাদ্য। এখানকার বাসমতি চাল আর খাসি দিয়ে তৈরি ‘কাচ্চি বিরানি’ ভুবন বিখ্যাত। ভারতীয় মুসলমানদের ইফতারি আইটেম কী হবে, সেটা নির্ভর করে তারা কোন এলাকার বাসিন্দা। হায়দরাবাদে প্রসিদ্ধ হালিম, তামিলনাড়ু কেরালায় ‘নবনুকঞ্জি’, যা গোশত-সবজির মিশ্রণে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার ইফতারির প্রধান অনুষঙ্গ, এছাড়া স্থানীয় খাবার তো রয়েছেই। দিল্লি, উত্তর ও মধ্য প্রদেশসহ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা ইফতারির সময় মসজিদে জড়ো হয়, এখানে ফ্রি ইফতারির ব্যবস্থা থাকে। ভারতের সর্বত্র ইফতারিতে স্থানীয় নানা পদের সঙ্গে সমুচা, খেজুর আর শরবত থাকা চাই। 
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া আর ব্রুনাইয়ের মুসলিম সংস্কৃতি প্রায় একই রকম। তারা ইফতারকে ‘বারবুকা পুয়েসা’, ‘বুকা পুয়েসা’ বলে। শুকনো খেজুর, আখের রস, সয়ামিল্ক, জেলি মালয় মুসলিমদের প্রিয় খাদ্য। ইন্দোনেশিয়ানরা সে দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার ও পানীয় গ্রহণ করে। ‘এস কাম্পার’, ‘কোলাক’, ‘এস কেলাপা’, ‘এস বুশ’ নামক তৈরি খাবার তারা ইফতারির সময় খেয়ে থাকে। আর মাগরিবের সময় ইফতারের জন্য তারা ‘বাদাং’ নামক বাদ্যযন্ত্র দ্বারা তোপধ্বনি করে জানান দেয় ইফতার সমাগত। ব্রুনাইয়ে আঞ্চলিক মসজিদগুলোয় ইফতারির ব্যাপক আয়োজন থাকে। ‘ইফতার বুফে’তে স্থানীয় মজাদার ও বিপুল খাবারের সমাহার থাকে। মালদ্বীপের প্রধান ইফতারি হচ্ছে শুকনো খেজুর। এছাড়া আনারস, আম ও ঠাণ্ডা জুসও জনপ্রিয়। প্রতিটি মসজিদে ফ্রি খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয় এখানে। শ্রীলঙ্কান মুসলিমরা সমুচা, কাটলেট, রোল আর খেজুর প্রভৃতি খেয়ে থাকে ইফতার মুহূর্তে। নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ইফতারিতে যোগ দেয়ার অভ্যাস তাদের দীর্ঘদিনের।
রাশিয়ার দাগেস্তান, চেচনিয়া, তাতারস্থান অঞ্চলগুলো মুসলিম অধ্যুষিত। রাশিয়ার মুফতি কাউন্সিল পাবলিক ইফতারের আয়োজন করে থাকে। এখানকার রোজাদাররা খেজুর, ফল, স্যুপ ও স্থানীয় মজাদার খাবার গ্রহণ করে ইফতারের প্রাক্কালে। আর ‘কিবাস’ নামক পানীয় ছাড়া তাদের আর চলে না। তাইওয়ান, চীন, হংকংয়ের সংস্কৃতি প্রায় একই। তারা খেজুর, ফল ও পানীয় নেয় ইফতারির সময়। চীনা মুসলিমদের এখন বড় দুর্দিন চলছে। এ বছর রোজা নিষিদ্ধ করেছে চীন সরকার। স্বাস্থ্যহানির ফলে কর্মস্পৃহা কমে যাবে- এ অজুহাতে রোজাকে নিষিদ্ধ করা হয়। 
ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয় সামাজিকভাবে মসজিদে ইফতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। রুটি, মুরগি, হাঁস, ছাগলের গোশত ও আলু দ্বারা তৈরি খাবার এখানকার ইফতারের মূল আইটেম। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিমরা সাধারণত বাড়ি, মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারে ইফতারে যোগ দেন। 
আধুনিক খাবারের প্রতি তারা আগ্রহী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোজাকে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়। ১৮০৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন সর্বপ্রথম ইফতার পার্টির আয়োজন করেছেন হোয়াইট হাউসে। তখন থেকে প্রতি বছর রমজানে মুসলিমদের সম্মানে হোয়াইট হাউসে ইফতারির আয়োজন করে থাকেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আমরা বাংলাদেশীরা ‘রোজা খুলি’ (ইফতার) সবাই মিলে। শহরের বাসিন্দাদের প্রিয় খেজুর, জিলাপি, হালিম, দহিবড়া, বুট-মুড়ি, বেগুনি, নানা ধরনের চপ, পেঁয়াজু প্রভৃতি। এছাড়া মৌসুমি ফলমূল ও শরবত বেশ জনপ্রিয়। 
শহরের সচ্ছলরা বিরিয়ানি, চিকেন গ্রিল, গোশত দিয়ে তৈরি নানা ধরনের কাবাবসহ হরেক রকমের আইটেম বেছে নেয় ইফতার বাজার থেকে। পুরান ঢাকা ইফতার বাজারের জন্য বিখ্যাত। গ্রামীণ মানুষের ইফতারির ঐতিহ্যবাহী পদ হচ্ছে চিড়া-মুড়ি-গুড় ভেজানো সুস্বাদু ঠা-া খাবার, যা শরীরকে শীতল রাখে। এখানে ‘রুহ আফজা’র পাশাপাশি ইসুবগুল ও লেবুর রস মিশ্রিত শরবতও বেশ জনপ্রিয়। 
জাতীয় পর্যায়ে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিকরা মহাসমারোহে ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকে মাসজুড়ে। এতে শুধু দলীয় ও আমন্ত্রিতরাই যোগ দিতে পারেন। শহর ও নগরের মসজিদ-মাদরাসা-খানকায় স্থানীয়দের উদ্যোগে সবার অংশগ্রহণে প্রতিদিন ইফতার অনুষ্ঠান এখানকার পরিচিত চিত্র। মসজিদ থেকে ‘আল্লাহু আকবর’ সুমধুর ধ্বনি শোনামাত্র পানি বা শরবত মুখে দিয়ে এদেশের মুসলিমরা সিয়াম সাধনার অবসান ঘটান।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!