ইসলাম শব্দটি আরবি ‘সিলমুন’ শব্দ থেকে উত্কলিত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, আনুগত্য, আত্মসর্ম্পণ, সন্ধি, বিরোধিতা, পরিত্যাগ ইত্যাদি। ইসলাম ন্যায় ও সাম্যের ধর্ম। ইসলামী উম্মাহকে মধ্যমপন্থী তথা উত্তম ও ন্যায়পরায়ণ উম্মাহ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। তাকে সুঠাম ও সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টিগতভাবে তাকে দান করা হয়েছে বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তা ও উপলব্ধির শক্তি, যাতে সে বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সঠিক, যথার্থ ও ন্যায় কাজটি করতে পারে; অন্যায়, অবিচার ও অসত্য বর্জন করতে পারে। যা কিছু সৎ, সত্য ও সুন্দর, ইসলাম তা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। তাই ইসলামে জঙ্গিবাদের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই। ইসলামে জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক কারণ আছে। এখানে এর বিশেষ ১০টি কারণ উল্লেখ করা হলো।
১. মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামী আইনের লক্ষ্য : হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামেদ আল গাজালি (রহ.) লিখেছেন : সৃষ্টির ব্যাপারে ইসলামী শরিয়াহ আইনের চূড়ান্ত লক্ষ্য পাঁচটি। ১. ধর্ম সুরক্ষিত করা। ২. সব মানুষের দৈহিক নিরপত্তা বিধান। ৩. সবার বিবেক-বুদ্ধির হেফাজত করা। ৪. সবার বংশ সংরক্ষণ করা। ৫. সবার সম্পদের হেফাজত করা।
ইসলামের শিক্ষা হলো, একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ (আপনার প্রতি শান্তি ও কল্যাণ বর্ষিত হোক) বলা। এর উদ্দেশ্য হলো, আমি আপনার শান্তি ও কল্যাণকামী। আমাকে আপনি আশ্রয় ও নিরাপত্তাস্থল হিসেবে পাবেন। আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি সাধিত হবে না। এর আলোকে জানা যায়, কোনো মুসলমান অন্যের জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠার সুযোগ নেই।
২. প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান তো ওই ব্যক্তি, যার জবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে।’ (সহিহ বুখারি) তাই প্রকৃত মুসলমান মুখ ও হাত দিয়ে অন্য ভাইকে কষ্ট দিতে পারে না। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানকে কটূক্তি করা পাপ, আর হত্যা করা কুফরি।’ (সহিহ বুখারি)
মহানবী (সা.) বিদায় হজের দিন মিনায় বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর এ দিন, এ মাস ও এ শহরের মতো চিরদিনের জন্য একে অন্যের রক্তপাত করা, সম্পদ নষ্ট করা ও সম্মান হানি করা হারাম করে দিয়েছেন।’ (প্রাগুক্ত)
বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সম্ভ্রম তেমনি পবিত্র, যেমন আজকের দিন, এই মাস ও এই শহর পবিত্র।’ (বাজজার)
সুতরাং প্রকৃত মুসলমান অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করতে পারে না।
৩. মানবহত্যা মহা অপরাধ : ইসলামের দৃষ্টিতে মানবহত্যা জঘন্যতম পাপ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময় ছাড়া কাউকে হত্যা করল, অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করার জন্য কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার (পৃথিবীর সব মানুষের) জীবন রক্ষা করল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২) অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘ফিতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৭)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে দূরে থাকবে।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! বিষয়গুলো কী কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন—১. ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, ২. জাদুটোনা করা, ৩. যথাযথ কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, ৪. সুদ খাওয়া, ৫. এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, ৬. যুদ্ধের দিনে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, ৭. সরলা নির্দোষ নারীদের নামে ব্যভিচারের দুর্নাম রটনা করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৬৬)
৪. জঙ্গিবাদ দয়া-মায়াহীন কাজ : আল্লাহ হলেন দয়ার আধার। তিনি মহাক্ষমাশীল ও করুণাময়। হাদিস শরিফে রয়েছে, আল্লাহ তাঁর রহমত ও দয়ার ১০০ ভাগের মধ্যে ৯৯ ভাগই নিজের কাছে রেখেছেন। অবশিষ্ট একভাগ সব সৃষ্টির মধ্যে বিতরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-রাসুলগণকেও দয়া-মায়ার গুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের মহানবী (সা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।’ (সুরা : আলে ইমরান : ১৫৯) সুতরাং জঙ্গি তত্পরতা এবং দেশে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা ধর্মবহির্ভূত কাজ।
৫. জঙ্গিবাদ নবীদের আদর্শের পরিপন্থী আল্লাহ তাআলা পথহারা মানুষকে সুপথে আনার জন্য এবং পৃথিবী থেকে অন্যায়-অনাচার, খুনখারাবি বিদূরিত করার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। নবীরা ছিলেন মাসুম-নিষ্পাপ। রাসুলুল্লাহ (সা.) তায়েফের ময়দানে কাফিরদের হাতে নির্যাতিত হয়েও বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, তাদের হেদায়েত দান করুন, তারা নবী হিসেবে আমাকে চেনে না।’ আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
সব নবী-রাসুলই নিজ উম্মতের হিতাকাঙ্ক্ষী ও আশ্রয়স্থল ছিলেন। মহানবী (সা.) মক্কায় ১৫ বছর বয়সে হিলফুল ফুজুুল গঠন করেন। মদিনায় গিয়ে মদিনা সনদের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তাই নবী-রাসুলদের খাঁটি অনুসারীরা জঙ্গিবাদে জড়াতে পারে না।
৬. অন্যায় হত্যাকাণ্ড কাবিলের আচরণ পৃথিবীতে প্রথম হত্যাযজ্ঞ চালায় আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিল। এর ফলে কাবিল ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কাবিল বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।’ সে (হাবিল) বলল, ‘আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো (কোরবানি) গ্রহণ করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত করো, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হাত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২৭ ও ২৮)
৭. অন্যায়ভাবে হত্যা করা কবিরা গুনাহ হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ, বিশেষত নরহত্যা মানবতাবিধ্বংসী অপরাধগুলোর অন্যতম। যে ব্যক্তি একজন মানুষকে হত্যা করে, সে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার দায়ে দায়ী। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বেআইনি উত্তেজনার বশীভূত হয়ে মানুষের জীবন সংহার করা কবিরা গুনাহ। এমনকি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকেও হত্যা করা যাবে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১৬৬)
৮. ইসলামে হত্যাকারীর শাস্তি
সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধী সাব্যস্ত হলে হত্যাকারীর শাস্তি হবে দুই ধরনের। (ক) পরকালীন ও (খ) ইহকালীন। পরকালীন শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার শাস্তি হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম, তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত। আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তি তৈরি করে রেখেছেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৯৩)
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘সব গুনাহই হয়তো আল্লাহ মাফ করে দেবেন, তবে দুই ব্যক্তি ব্যতিরেকে—এক. যে ব্যক্তি কাফির অবস্থায় মারা যায় এবং দুই. যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে খুন করে।’ (নাসাঈ)
খুনির ইহকালীন শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি তাদের প্রতি এতে (হত্যায়) শাস্তি নির্ধারণ করেছি। আর তা হলো জীবনের বিনিময়ে জীবন, চোখের বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত ও জখমসমূহের বিনিময়ে রয়েছে কিসাস।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৫)
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ‘হে জ্ঞানীরা! তোমাদের জন্য কিসাসে (মৃত্যুদণ্ডে) রয়েছে জীবন, যাতে তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭৯)
৯. খুনখারাবি ফেরেশতাদের কাছে ঘৃণিত আল্লাহ তাআলার রাজ্যের ব্যবস্থাপনার কার্যনির্বাহী ও বিশ্বস্ত ফেরেশতাগণও খুনখারাবিকে ঘৃণা করেন। আল্লাহ তাআলা যখন আদম সৃষ্টির লক্ষ্যে ফেরেশতাদের কাছে পরামর্শ চান, তখন ফেরেশতাগণ বলেন, ‘আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে দাঙ্গাহাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত আপনার গুণকীর্তন করছি এবং আপনার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি।’ (সুরা : বাকারা : ৩০)
এতে প্রমাণিত হয় যে খুনখারাবি ফেরেশতাদের কাছেও ঘৃণিত ও নিন্দনীয়।
১০. মুমিনের আসল পরিচয়
কারো বাহ্যিক বিষয় দেখে মুমিন বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। অনেক অমুসলিমও দাড়ি, টুপি ও পাঞ্জাবি পরে। তাই বলে সে মুসলমান নয়। প্রকৃত ইমান অন্তরে বিশ্বাস ও আমলের নাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মানুষের বাহ্যিক অবস্থা ও ধনসম্পদের দিকে তাকান না; বরং তার অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।’ কাজেই যার কাজকর্ম আল্লাহ তাআলা ও তাঁর হাবিবের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয় না, দাড়ি, টুপি ও পাঞ্জাবি থাকলেও সে প্রকৃত মুমিন নয়।
সমাপনী : ইসলাম কোনো অন্যায় ও অপরাধ সমর্থন করে না। কেননা ইসলাম বিশ্বস্রষ্টার মনোনীত একমাত্র দ্বীন। ইসলাম সত্য, সুন্দর ও সহিষ্ণুতার ধর্ম। ইসলাম ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রবক্তা। ধর্মীয় সহনশীলতা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘সুন্দর ও উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সঙ্গে বিতর্ক কোরো না।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৪৬)
ইসলাম মানবীয় ভ্রাতৃত্বের এমন এক অনুপম নিদর্শন পেশ করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। ইসলামের দৃষ্টিতে গোটা মানবজাতির উৎসমূল এক ও অভিন্ন। একই পুরুষ ও নারী থেকে সব মানুষ উদ্ভূত হয়েছে। তাই সব মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসবে—এটাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে জঙ্গিবাদ, অন্যায়-অবিচার, খুনখারাবি ইত্যাদির কোনো স্থান নেই। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলামে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে হারাম ও অমার্জনীয় অপরাধ। খবর-কালেরকন্ঠ।
লেখক : প্রধান মুফতি, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী
সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন
আপনার মতামত লিখুন :