• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
বিএনপির রূপরেখা

ইসি পুনর্গঠনে খালেদার ২০ প্রস্তাবে কী আছে?


মেহেদী হাসান নভেম্বর ১৮, ২০১৬, ১০:৫১ পিএম
ইসি পুনর্গঠনে খালেদার ২০ প্রস্তাবে কী আছে?

ঢাকা: অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন, শক্তিশালী ও দলনিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন চাইলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরলেন নতুন নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সেই কমিশনের অধীনে কীভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে-এমন সব দলীয় প্রস্তাবনা। 

নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এই কমিশনকে শক্তিশালী করতে মোট ২০টি প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এর মধ্যে সাতটি দফা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠনে। আর কমিশনকে শক্তিশালী করতে রয়েছে ১৩ দফা। 

দেশের নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পাশাপাশি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্যের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করতে পাঁচ সদস্যের ‘সার্চ কমিটি’ গঠনেরও কথা বলেছেন। 

সেই ৭টি প্রস্তাব
১. সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
২. দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বৈঠক হতে হবে। বৈঠকে ২০ দলীয় জোট ও মহাজোটের একজন করে মূল প্রতিনিধি ও সহায়তা দিতে আরো দুজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারবেন।
৩. ‘সার্চ কমিটি’ করতে হবে। এই কমিটিতে একজন নারী সদস্য রাখতে হবে। একই সঙ্গে ‘সার্চ কমিটি’র গঠন, কাঠামো, সদস্য কারা হবেন, এ নিয়েও প্রস্তাবে মত দেয়া হয়েছে।
৪. নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, স্বাধীনতার পর সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেÑএমন রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে ‘সার্চ কমিটি’র সদস্যদের প্রতিজনের বিপরীতে দুজনের নাম ও পরিচয় সুস্পষ্টভাবে লিখিত প্রস্তাব দিতে হবে।
৫. প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
৬. এবং ৭.  নম্বরে ‘সার্চ কমিটি’ ও গঠন প্রক্রিয়া, ঘোষণার বিষয়ে বিস্তারিত ও সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে অভিমত পেশ করেন।

এই প্রস্তাবগুলোর বাইরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইসিকে অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আরপিও সংশোধনের দাবি জানান। তিনি পরিষ্কারভাবে পাঁচটি ক্ষেত্রে সংশোধনীর কথা বলেন। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে বিএনপি প্রধান আরো ১৩টি প্রস্তাব দেন :
১. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় করতে হবে।
২. কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রেষণে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত প্রকাশ্য রাজনৈতিক মতাবলম্বী নির্বাচনী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
৪. রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব। 
৫. নির্বাচনের সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকবে। তা হলোÑস্বরাষ্ট্র, অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পররাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
৬. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকার পূর্ণ সীমানা পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
৭. নির্বাচনকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ ও নতুন ভোটার নিবন্ধিত করতে হবে।
৯. নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে।
১১. নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন এই দফায়।
১৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়েও আলোচনা করেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সৎ, সাহসী, অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। এ ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতার কথাও তুলে ধরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চারজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হবেন। জেলা জজের পদমর্যাদাসম্পন্ন, ন্যূনতম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন, সিনিয়র আইনজীবী, বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হবেন। পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটিতে থাকবেন সাবেক প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, দক্ষ ও যোগ্য নারী। 

একজন নারীসহ চারজন কমিশনার নিয়োগের প্রস্তাব করে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের হতে হবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও দলনিরপেক্ষ। এ ছাড়া ‘সার্চ কমিটি’র কাছে নিবন্ধিত দেশের সব রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো দুজন করে নাম প্রস্তাব করতে পারবে। সেখান থেকে ‘সার্চ কমিটি’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে চূড়ান্ত মনোনয়নের পর কেউ যদি দায়িত্ব পালন করতে অসম্মতি জানান, তবে একই প্রক্রিয়ায় আবারও বাছাই করতে হবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া।  

খালেদা জিয়া বলেন, তফসিল ঘোষণার পর মাঠ প্রশাসনে বদলির এখতিয়ার থাকতে হবে নির্বাচন কমিশনের। বিগত পাঁচ বছরে যে যে কর্মকর্তা জেলা ও উপজেলায় কাজ করেছেন, তাদের নতুন এলাকায় বদলি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি কমিটি গঠন করবে, যে কমিটির কাজ হবে প্রজাতন্ত্রের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ২০০৮ ও ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের নির্বাচনী দায়িত্বে না রাখা। 

এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কিংবা কোনো দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী ব্যক্তি নির্বাচন পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না বলেও নিজের প্রস্তাবনায় জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। নির্বাচনী আইন ভঙ্গের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করবে। নির্বাচনের সময় কমিশন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের সময় ব্যালট বাক্স পরিপূর্ণ হয়ে গেলে তা পোলিং বুথেই রাখতে হবে। ভোট নেয়ার পর খালি ব্যালট বাক্স যদি থাকে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রাখতে হবে।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার দাবি জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন তার প্রস্তাবনায় বলেন, ১৮ বছর বয়সী দেশের সব নাগরিককে ভোটার করতে হবে। ভোটার করতে হবে প্রবাসীদেরও। 

অন্যদিকে নির্বাচনকালীন প্রশাসন যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। ভোটকেন্দ্রে ছবিসহ ভোটার তালিকা সরবরাহ করতে হবে, যাতে কেউ জাল ভোট দিতে না পারে। যাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তারা যেন কোনো বাধা ছাড়াই ভোট দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও  করতে হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীর নিযুক্ত এজেন্টকে ভয়হীন ও নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গণনা শুরু করতে হবে। কোনো ধরনের বিরতি ছাড়াই ভোট নিতে হবে। নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষক রাখতে হবে।

নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ছাড়া এসব পথপদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত প্রস্তাব তুলে ধরা হবে।

রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপির রূপরেখা উপস্থাপনার এই সংবাদ সম্মেলনে দলীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এনাম আহমেদ চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মীর নাছির, শামসুজ্জামান দুদু, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, আবদুল মান্নান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, গোলাম আকবর খন্দকার, মিজানুর রহমান মিনু, রুহুল আলম চৌধুরী, ড. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, নিতাই রায় চৌধুরী, আহমেদ আজম খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, মশিউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আ ন হ আখতার হোসেন, ডা. সিরাজউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব সারোয়ার হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন। 

২০ দলীয় জোটের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ,  জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মহিউদ্দিন ইকরাম প্রমুখ। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদের জন্য আসন নির্দিষ্ট থাকলেও এতে দলটির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। 

এ ছাড়া প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোস্তহিদুর রহমান, প্রফেসর দিলারা চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সোনালীনিউজ/এমএন

Wordbridge School
Link copied!