• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ আনন্দের একাল ও সেকাল


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৭, ২০১৮, ১২:১৯ পিএম
ঈদ আনন্দের একাল ও সেকাল

ঢাকা : বাঙালি মুসলমানদের অন্যতম প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর (রমজানের ঈদ) এবং ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ)। মুসলিম ধর্মপ্রধান বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ বিরাজ করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও। ঈদের উৎসবমুখরতা আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যুগবন্ধনে এখন বর্ণিল কলেবরে বিস্তৃত হয়েছে।

যদিও সেকালের ঈদের উৎসব ছিল প্রধানত ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি রেওয়াজের মোক্ষম শক্তি। ঈদের আনন্দের রঙ-রূপ পরিবর্তন হলেও ঈদের ধর্মীয় ভাবাবেগ মূলত একই রকম। যুগ-যুগান্তরের কালপরিক্রমা পেরিয়ে বাঙালি মুসলমানদের ঈদ উৎসব উদযাপনের রীতি-রেওয়াজ, রঙ-রূপ, কৃষ্টি ও আচারের নানা দিক নিয়ে সাতকাহনের আজকের আয়োজন...

এই ঈদ সেই ঈদ

ওই তো চাঁদ উঠল বলে। দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদের আনন্দ। ঈদের আনন্দটা যতটা বর্তমান তার চেয়ে বেশি যেন অতীত ও ভবিষ্যতের। কথাটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ঈদের আগে থেকেই মনের ভেতরে একটা ছটফটানি শুরু হয়ে যায়, একটা উৎসবের আমেজ- কেনাকাটা, বেড়ানো, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া সব মিলিয়ে বিরাট এক আয়োজন। কিন্তু, ঈদের দিন যেন ব্যাপারটা কেমন স্বাভাবিক ঠেকে- এ-ই ঈদের আনন্দ! কী যেন করতে মন চায়, কী যেন করা যায় না, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার মনেই এরকম একটা অনুভ‚তি খেলা করে- কত কিছু যেন বাকি রয়ে গেল! ঈদ আবার ফিরে আসে বহু বছর পরে- স্মৃতিকাতরতায়। বড় হয়ে গেলে ছোটবেলার ঈদের স্মৃতিগুলো মনে হয়- দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি বেড়ানোর কথা। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কথা আর রাতভর দিনভর আড্ডা।

ঈদ মানে উৎসব। আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। প্রতি বছর ঈদ নতুন নতুন আবহ নিয়ে ফিরে এলেও পুরনো আবেশটা ঠিকই রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। সেই ছোটবেলার কার্ডকেনা, চাঁদ রাতে দল বেঁধে মেহেদি দেওয়া। একটু বড় যারা তারা কিনে আনতেন ঈদ উপলক্ষে বের হওয়া নতুন গানের ক্যাসেট। সেগুলো খুব জোরে জোরে বাজত পাড়ায়-মহল­ায়। আর চাঁদ উঠলেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে শুরু হয়ে যেত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গান- ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে শোন আসমানি তাগিদ।’ এর চেয়ে অসাধারণ ঈদের গান আর হয় না। এই গান না শোনার আগ পর্যন্ত মনেই হয় না যে ঈদ এসেছে।

গ্রামে গ্রামে একসময় ঈদ উপলক্ষে আয়োজন করা হতো নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, হাডুডু ও ফুটবল খেলার। খুবই উৎসবমুখর ছিল বিবাহিত ও অবিবাহিতদের কাবাডি বা ফুটবল খেলার। গ্রামীণ সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে অনেকটা। মানুষ এখন শহরমুখী। ঈদের আগের দিন বাড়ি যায়। ঈদের দিনটা তাদের চলে যায় নানারকম ব্যস্ততায়। অনেককে ঈদের একদিন, দুদিন পরই আবার শহরে ছুটতে হয়। মিলনের আগেই বিচ্ছেদ। তাও ঈদই এখন সারাবছরের একমাত্র মিলনমেলা।

দিনে দিনে ঈদ আরো রঙিন ও উৎসবমুখর হয়ে উঠছে। এর কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নতি। ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই বাংলায় একশ বছর আগেও ঈদ তেমন উৎসবের ব্যাপার ছিল না। অল্পকিছু ধনী লোক এ দিন উৎসব পালন করতেন। বিশাল দরিদ্র শ্রেণি রয়ে গিয়েছিল উৎসবের বাইরেই। এখন অর্থনীতি উন্নতির ফলে সবাই কম-বেশি কিছু কিছু অংশগ্রহণ করতে পারে ঈদ-উৎসবে। একেবারে দিনে এনে দিনে যে খায় সেও একটু আয়োজন করে সেমাইয়ের, ভালো খাবারের। ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা কিনে। নবীজি বলেছিলেন, ঈদ হতে হবে সবার। যেন একজন মানুষও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়। প্রতিটি শিশুরই যেন থাকে নতুন জামা। ঈদ শুধু নিজের জন্য নয়, ঈদের প্রধান মহিমা হচ্ছে অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার।

ছোটদের ঈদ

ঈদ মানে আনন্দ। বাচ্চাদের মধ্যে এই আনন্দের রেশ সবচেয়ে বেশি। সেই ছোটবেলার ঈদের কথা ভেবে এখনো চোখে-মুখে আনন্দ দেখা দেয় বুড়োদেরও। এক ধরনের নষ্টালজিয়া পেয়ে বসে তাদের। ছোটবেলার ঈদ মানেই নতুন পোশাকে বাবার হাত ধরে নামাজে যাওয়া। ঈদের নামাজ শেষ মুরুব্বিদের সালাম করতাম আর মিলত নতুন নতুন টাকার নোট। তার মধ্যে একটা অন্যরকম অনন্দ ছিল। দল বেঁধে পাড়া-পড়শিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিঠা পায়েস খাওয়া। ঈদের দিন সকালে বন্ধুরা মিলে একচলি­শ ঘরে খাওয়ার চেষ্টা। ঈদের চাঁদ দেখা নিয়েও আনন্দ উৎসাহের শেষ ছিল না। চাঁদ দেখা গেলেই পাড়া-মহল­ায় চলত সবাইকে ঈদের খবর জানানোর মিছিল। চাঁদ রাতটা যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইত না উত্তেজনায়। ঈদের দিন সকাল হলেই গোসল করে লুকিয়ে রাখা জামাটা পরতাম।

প্রচলিত ধারণা ছিল ঈদের নতুন জামা কাউকে দেখানো যাবে না। কেউ আগেভাগে দেখে ফেললে যে আনন্দটাই মাটি! সেই সময়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য ঈদকার্ড ও নানা রকম ভিউকার্ডের প্রচলন ছিল। ঈদের দিন শিশু-কিশোররা মিলে নানা রকম ইস্টিকার, ভিউকার্ডের পসরা সাজিয়ে বসতেন। এর মাধ্যমে দুই পয়সা লাভ নয় উদ্দেশ্য ছিল আনন্দ ভাগাভাগি করা। ঈদ মানেই একটু বাড়তি স্বাধীনতা। এইদিন বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ালেও থাকত না বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি। বন্ধুরা মিলে সালামির টাকা নিয়ে ভিড় জমাতাম খেলনার দোকানগুলোতে।

পিস্তল, রঙ-বেরঙের বেলুন, বাঁশি, পাস্টিকে সাপ কত রকম বাহারি নাম তাদের। এদের মধ্যে বেশি কদর ছিল –লাদেন বোম নামে একটি বিশেষ খেলনার। এটি আকাশে ছুরে মারলে মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠুস করে শব্দ করে উঠত। ঠুস শব্দের সঙ্গে শিশু-কিশোররা মেতে উঠত বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াসে। এই আনন্দের রেশ থাকত টানা কয়েক দিন।
ঈদের সালামির বড় একটা অংশ বরাদ্দ থাকত ভাড়া সাইকেল চালানোর জন্য। তখন ১০ টাকার বিনিময়ে পুরো ১ ঘণ্টার জন্য সাইকেলটি নিজের করে নেওয়া যেত। সাইকেল নিয়ে দল বেঁধে চষে বেড়ানো হতো পুরো গ্রাম। তারপর থাকত সিনেমা দেখতে যাওয়ার পালা। কোনো কারণে সিনেমা না দেখে বাড়ি ফিরলে তার আফসোস মিটত না কিছুতেই।

কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল হাওয়ায় বদলে গেছে ঈদের চিত্র। এর প্রভাব পড়েছে ঈদ আনন্দেও। এসব আনন্দ আজ মিলিয়ে গেছে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস্যাপের মতো যোগাযোগ মাধ্যমের ইমোজির মধ্যে। ঈদকেন্দ্রিক আনন্দ ও শুভেচ্ছা ডিজিটাল মাধ্যমে প্রাণ হারিয়েছে। এখন আর কেউ কাউকে ভিও কার্ড বা ঈদকার্ড দেয় না। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে তারা ফেসবুক স্ট্যাটাস, সেলফি ও লাইক কমেন্টে আটকে আছে। যার ফলে এ কালের ও সে কালের ছোটদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ঈদ আনন্দের বিস্তর ফাড়াক। চাঁদ দেখা নিয়েও নেই কোনো উচ্ছ¡াস। আগের মতো ২৯-৩০ রোজায় সন্ধ্যার সময় ভিড় করে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না কেউ। এর চেয়ে প্রচার মধ্যমেই ঈদের চাঁদ দেখা গেছে ধরনের ঘোষণায় বেশি অভ্যস্ত।

উৎসবের কলেবর বাড়লেও কমেছে সামাজিক সম্প্রীতির উচ্ছ্বাস

বাঙালি মুসলমানদের জীবনে ঈদ অনাবিল আনন্দের উৎস। সে একাল হোক অথবা সেকাল। সেকালের ঈদে আর্থিক চাকচিক্যের প্রাচুর্য না থাকলেও ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রাচুর্য। সেকালের ঈদে ছিল চিরায়ত গ্রামীণ আবহ, সংস্কৃতি আর কৃষ্টির মহামিলন। তখন ছিল চিঠির যুগ। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। পরিবারের সদস্যরা ঈদে বাড়ি আসবে এমন বার্তা আসত ডাকযোগে-চিঠিতে। আর তখন থেকেই দিন গোনা শুরু হতো।

ঈদ আসছে...ঈদ আসছে। বাবা-মায়েরা প্রস্তুতি নিতেন। ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতকুরের জন্য নানা রকমের পিঠা, পাপড় তৈরি করতেন মায়েরা। মসলা ভাঙাও, আতপের চাল তৈরি করা, পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন জামা-কাপড় তৈরি করা আর বাজার-সদাইয়ের লম্বা লিস্টি নিয়ে বাজারে যেতেন বাবা। ঈদ ঘনিয়ে এলে বাড়িঘর যেন আনন্দের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হতো।

তারপর ঈদের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে ঈদ আনন্দ অন্যরকম উচ্ছলতায় ভরিয়ে রাখত মনপ্রাণ। আর একালে মোবাইল, এসএমএস, ফেসবুকের ডিজিটাল জমানায় ঈদের সেই প্রাণ আকুলতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখন ঈদের চাঁদ দেখা নির্ভর করে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজে চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণার সংস্কৃতিতে। ফেসবুকে ‘ঈদ মোবারক’ স্ট্যাটাস, ম্যাসেঞ্জারে ঈদ কার্ড অথবা এসএমএসে ঈদের শুভেচ্ছা বার্তায় বন্দি হয়ে আছে আমাদের আবেগ-অনুভ‚তির রেশ।

ডিজিটাল জমানায় সেকেলে বাবা-মায়ের সন্তানের দর্শনের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষার পালা কখনো কখনো অপেক্ষাতেই থেকে যায়। এ কথা সত্যি, সেকালের মতো আর্থিক দৈন্য একালে নেই। এখন আছে অর্থ প্রদর্শনের বাহুল্যপনা। তবে মানসিক দৈন্য বেড়ে গেছে বহুগুণে। আমাদের অনুভূতি, আবেগের জায়গাগুলোও যেন ডিজিটালাইজড (ভোঁতা) হয়ে গেছে। আহারে একালের দিনে ঈদের পিঠা তৈরির জন্য ঢেঁকির ঢকঢক শব্দ কোথায় পাব আজ। দল বেঁধে কিশোরীদের মেহেদি বাটার হই-হুলে­াড় এখন রেডি টিউব মেহেদিতে বন্দি হয়ে গেছে।

সেকালে মা-বোনরা ঈদের আগে কাদামাটি দিয়ে ঘরের মেঝেতে আল্পনা আঁকত। বিছানা ও আসবাবপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখত। পরিবারের দায়িত্ববান পুরুষ ঈদের আগে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে ঈদের দিনের দাওয়াত করে আসতেন। আর একালে ফেসবুকে ঈদ কার্ড অথবা মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা বার্তা কিংবা ফোন কলে ঈদ আমন্ত্রণে কি সেই আবেগের রেশ পাওয়া যায়! সেকালে পুরুষরা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ঈদগাহে নামাজ আদায় করে এলাকার সব বাড়িতে যেতেন। একালের ফ্ল্যাট কালচারে বহুতল বিল্ডিংয়ে একছাদের তলায় থাকলেও কেউ কারো খোঁজ নেয় না।

ঈদের দিনে সময় কাটে টিভি অনুষ্ঠান দেখে। সময় না থাকায় আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়ানো হয়ে ওঠে না। সবার মধ্যেই একটা ব্যস্ততার ভাব ও কৃত্রিমতা থাকে। সত্যিকার অর্থে সেকালের ঈদের আনন্দের রেশ একালে পাওয়া খুব কঠিনও বটে। কারণ, জীবন এখন যন্ত্রের মতো ছুটছে অর্থ আহরণের কানাগলিতে। তাই মানবতা আর মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে জীবনগতির বাঁকে বাঁকে...।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!