• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে, এখানে খুঁজিয়া পাইবে না’


মো. আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি জানুয়ারি ২৮, ২০১৮, ১১:০৩ এএম
‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে, এখানে খুঁজিয়া পাইবে না’

ঝালকাঠি: এ যেন পদ্মারপাড়ের সেই কেতুপুর গ্রাম। এখানেও দারিদ্র আর দুঃখ-শোকে কাটে অসংখ্য কুবের, মালা আর কপিলাদের নিত্যদিন। আছেন হোসেন মিয়ারাও।

ঝালকাঠি শহরে কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে যে নদী তার নাম সুগন্ধা। পুরো শহরটিকেই চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে শান্ত এ নদীটি। শহুরে সভ্যতার পূর্বে নদীবিধৌত উপকূলীয় এ জেলায় জেলে সম্প্রদায় সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে।

সভ্যতার ক্রমবর্ধমান ছোঁয়ায় আজকের বাণিজ্যিক শহর ঝালকাঠিতে সৃষ্টি হয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ নাগরিক জীবনের সব সুযোগ সুবিধা।

তবে ৩শ’ কিংবা তারও বেশি প্রাচীন এই জনপদের গোড়াপত্তনের দাবিদার জেলে সম্প্রদায়। এককালের সন্ধ্যা নদীর শাখা আজকের সুগন্ধা নদী ছোট্ট শহর ঝালকাঠিকে ঘিরে রেখেছে। বর্তমান শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি গুরুধাম ও শশ্মানঘাট নদীসলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠে জেলেদের বসতি। যা আজও ঝালোপাড়া নামে পরিচিত। কৈবর্ত জেলেদের ঝালো বলা হতো এবং তাদের বসতির এলাকাকে বলা হতো ঝালোপাড়া। অনেকের ধারণা এ ঝালোপাড়া থেকেই ঝালকাঠি নামের উৎপত্তি।

কবি বিজয়গুপ্ত মনসা মঙ্গল কাব্যেও জেলে সম্প্রদায়কে ঝালো নামে উল্লেখ করেছেন। পূর্বে প্রচীন বাণিজ্যিক বন্দর ঝালকাঠির অধিকাংশ নাগরিকই ছিল কৈবর্ত দাস বা জেলে সম্প্রদায়ের লোক।

অনেকের মতে, বর্তমান ঝালকাঠির পশ্চিম তীরে জেলেরা জঙ্গল পরিষ্কার করে বাসস্থান তৈরি করে। আর তা থেকে জেলে+কাঠি=জাল+কাঠি, অপভ্রংশে ঝালকাঠি নামকরণ করা হয়েছে। এই জেলে ও জঙ্গলের কাঠি থেকেই উৎপত্তি হয় ঝালকাঠির নাম। তেমনি চাঁদকাঠি, কৃঞ্চকাঠি, চরকাঠি, বিনয়কাঠি ইত্যাদি।

যা বিস্তৃত রয়েছে স্বরূপকাঠি পর্যন্ত। বিশ্বরূপ সেনের একখানা তান্ডর লিপিতে ঝালকাঠি ও নৈকাঠির নাম উল্লেখ রয়েছে। আর এ থেকেও ঝালকাঠি নামটি যে জেলেদের কাছ থেকে এসেছে তার সমর্থন পাওয়া যায়। তবে ঝালকাঠি জেলার প্রাচীন নাম ছিল মহারাজগঞ্জ। কিন্তু ঝালকাঠি নামেই জেলার নামকরণ হয়।
তিন-চারটি পরিবার থেকে আস্তে আস্তে শহরের চাঁদকাঠির সুগন্ধা পাড়ে জেলেপাড়া গড়ে ওঠে। এখানকার জেলেরা ঝালো ও মালো এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। সন্ধ্যার শাখা সুগন্ধা, বিশখালি, জীবনানন্দের ধানসিঁড়িসহ দূর-দূরন্তে সকাল-সন্ধ্যা কেটে যেত জেলেদের নৌকায় নৌকায়। আর নৌকা বোঝাই মাছ গঞ্জের হাটে বেচাকেনার পর চাল-ডাল, গৃহস্থলী নিয়ে বাড়ি ফিরত জেলেরা। সেসময় জেলেপাড়ায় নানা উৎসব-পার্বণ লেগে থাকতো ১২ মাস।

এ অঞ্চলের জেলেরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। বারো মাসে তের পার্বণের মধ্যে জেলেপাড়ায় মনসা পূজো, বাস্ত পূজো, নীল পূজো, হোলি উৎসব আর গঙ্গা পূজোর ঘটা লেগে যেত নির্ধারিত দিনের ৭/৮ দিন আগে থেকেই। সেসময় জেলে পাড়ায় সকাল আর সন্ধ্যা হতো তুলসী তলায় জেলে নারীর শাঁখের ধ্বনিতে।

আজও জেলেপাড়ায় শাঁখের শব্দ বাজে, তবে এই শব্দে কান্নার নিদারুণ সুর ধ্বনিত হয়। মর্মস্পর্শী অনুভবে তা স্পষ্ট শোনা যায়।

জেলে যুবক বিপুল মালো (২০) বলেন, ‘গাঙে মাছ নাই। আমরা সরকারি সাহায্যও পাই না। তাই পিকআপ ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। আর ইলিশের সময় গাঙে থাকি।’

জেলেপাড়ার বয়োজেষ্ঠ্য নবদ্বীপ জেলে ৬৫ বছর বয়সের তুলনায় তিনি যেন আরো বৃদ্ধ। নদীতে মাছ ধরেই শৈশব থেকে বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। বছরের পর বছর নদীতে রোদ-বৃষ্টি আর শীত শরীরের ওপর দিয়ে গেছে। তাই নানা রোগ-শোকে এখন বিছানায়। তিনি জানান, এক সময় ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠি আর গুরুধাম এলাকা জেলেরাই জমিয়ে রেখেছিল। তখন নদীতে  মাছের টান (অভাব) ছিল না। এখন আর আগের মতো মাছ নেই। তাই অভাব দারিদ্র লেগেই আছে। সরকারি সাহয্য সহযোগিতা কিছুই পান না বলে তারও অভিযোগ।

আরেক জেলে যুবক বরুণ মালো (৩২) অভিযোগ করে বলেন, ‘এই শীতে হুনছি অনেকে গরিবগো কম্বল দেছে। মোগোতো কেউ একটাও দেলো না।’

ঝালকাঠি জেলা মৎস কর্মকতা প্রীতিষ কুমার মল্লিক জানান, জেলায় মোট জেলের সংখ্যা ৪ হাজার ৬শ’ ৩০ জন। এই সুগন্ধার জেলেরা প্রাচীন জনপদের ঝালো সম্প্রদায়ের বংশধর । আসলে লোকসংখ্যা ও জেলের সংখ্যা দুটোই বেড়েছে। আর ঝালকাঠি একটি পকেট জেলা। ভোলা, পটুয়াখালি, বরগুনা থেকে ছেঁকে ছেঁকে ইলিশ ধরা পড়ে। বাকি কিছু অংশ সুগন্ধায় আসে। তবুও ইলিশ সংরক্ষণে সরকার গত কয়েকবছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে তাতে নদীতে ইলিশ বেড়েছে। ঝালকাঠিও তার ব্যতিক্রম নয়।’

অন্যদিকে, সাধ্যমতো জেলেদের সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি এ কর্মকর্তার।

সুখ আর আনন্দে গাঁথা জেলেপাড়ায় সময়ের বিবর্তনে আজ চৈত্রের দাবদাহ। বর্ষা মৌসুম ছাড়া জেলেরা এখন মাছ দেখে না বললেই চলে। আর চরম দারিদ্রের দিনে নৌকা ও জাল সংগ্রহের অভাবে বেকার হয়ে পড়েছে জেলে যুবকরা। তাই পেশা হারিয়ে দিনদিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন অনেকে। শিশু-কিশোর আর নর-নারীর মুখরিত জেলেপাড়া এখন প্রায় জেলে শূন্য। ৮/১০টি জেলে সম্প্রদায় এখনো পূর্বপুরুষের পেশা আঁকড়ে জীবনযুদ্ধে কোনোমতে টিকে আছে। রাতের অন্ধকার যেন তাদের ভয়াল দারিদ্রের ছোবল আর সকালের তেজদীপ্ত সূর্যও যেন তাদের অনটনের অগ্নিকুন্ডু।

এনজিও, দাতা সংস্থাসহ সরকারি সংস্থার যেন জেলেদের এই  দুর্দিনে কিছু করার নেই। অথচ জেলেপাড়া ছাড়িয়েই গড়ে উঠেছে শহুরে সভ্যতা। তাই হতদরিদ্র জেলেপাড়া এখন নিজেই যেন বলছে-‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!