• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এই মেয়ে তোমার পেছনে কীসের দাগ?


রোকেয়া লিটা আগস্ট ২২, ২০১৭, ১১:১৯ এএম
এই মেয়ে তোমার পেছনে কীসের দাগ?

ফাইল ছবি

ঢাকা: পিরিয়ড বা ঋতুবর্তীতা নারীদের একটি প্রাকৃতিক ব্যপার। এখানে না আছে নারীর হাত; না আছে ডাক্তারের, আবার না আছে আজুহাত। তাই একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে এসব মেনেই দুনিয়াবী কাজ-কারবার করতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীদের মতই বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময় নারীদের এসব লুকিয়ে কাজ করতে হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। তেমনি কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সিঙ্গাপুর প্রবাসি লেখক-সাংবাদিক রোকেয়া লিটা। বিবিসি বাংলায় তার লেখা নিবন্ধটি সোনালীনিউজের পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

বেশ কয়েক বছর আগে একটি সংবাদ মাধ্যমের একজন নারী সাংবাদিক এবং তার নিউজ এডিটরের মধ্যকার একটি বাদানুবাদের ঘটনা আমার কানে এসেছিল।

একদিন হঠাৎ করেই নাকি ওই নারী সাংবাদিক অফিসে এসেও অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য অফিসের বাইরে যেতে চাইলেন না। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর ওই নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন নিউজ এডিটরের কাছে।

নিউজ এডিটর ভীষণ বিরক্ত হয়ে এ ব্যাপারে ওই নারীর কাছে কৈফিয়ত চাইলেন। ওই নারী সোজাসুজি জানিয়েছিল যে তার পিরিয়ড হয়েছে, সে অফিসের বাইরে যেতে অস্বস্তি বোধ করছে।

কিন্তু যতদূর জেনেছি, নিউজ এডিটর ওই নারী সাংবাদিকের সমস্যাটি মানতে চাননি। ফলে নিউজ এডিটর বলেছে, আপনাকে অ্যাসাইমেন্টে যেতে হবে, ওই নারী সাংবাদিক বলেছে না আমি যেতে পারবো না।

এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ বাদানুবাদ লেগে যায় যা পরবর্তীতে অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরাও জেনে যায়। কেউ কেউ অবশ্য ভাবতে পারেন, বসের মুখের উপরে কথা বলা অবাধ্যতা, তাদের জেনে রাখা উচিত, মেজাজ খিঁচড়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঋতুকালীন উপসর্গ।

এটি ভিন্ন একটি সংবাদ মাধ্যমের ভেতরের ঘটনা। আমি যেসব সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছি, সেসব জায়গাতেও এমন অসংখ্য উদাহরণ দেখেছি।

একদিন আমাদের একজন পুরুষ অ্যাসাইমেন্ট এডিটরকে দেখলাম, ডেস্কে বসে কয়েকজন পুরুষ সাংবাদিকের সামনে নারী সাংবাদিকদের নিয়ে রসিকতা করছেন। তাদের আলোচনার বিষয় হলো, প্রায়ই নাকি কোনো কোনো নারী সাংবাদিক অ্যাসাইমেন্ট এডিটরের কাছে এসে বলে, ‘আগামীকাল আমি অসুস্থ থাকব, আমার ছুটি লাগবে’।

অসুস্থতার আগাম খবর দেয়া এবং সে কারণে ছুটি নেয়া, ওই অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের কাছে নিতান্তই হাস্যকর একটি বিষয়। কোনো নারীর জীবনে যে নিজের অসুস্থতার আগাম তথ্য দেয়া সম্ভব, সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই ওই অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের।

পিরিয়ড নিয়ে অজ্ঞতার কারণেই কর্মস্থলে নারীদের অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। আমি নিজেও কম ভুক্তভোগী নই। ঋতুকালীন সময়গুলোতে ভীষণ পেটে ব্যথার কারণে হাঁটাচলা করতে পারতাম না বলে, মাঝে মাঝেই সর্দি-জ্বরের কথা বলে ছুটি নিতাম।

তখন আবার আমাকে শুনতে হতো, ‘হঠাৎ করে অসুস্থতার খবর দিলে অফিস চলবে কীভাবে? আপনার অ্যাসাইনমেন্টে কে যাবে এখন?’ তখন বাধ্য হয়ে আমাকে জবাব দিতে হতো, ‘অসুখ তো হঠাৎ করেই হয়, আগে থেকে জানতে পারলে তো ছুটি নিয়ে রাখতাম।’

আমি সাংবাদিক, তাই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ঋতুকালীন সময়ে মেয়েরা কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয় তার কিছুটা তুলে ধরলাম। অন্যান্য পেশায় বিশেষ করে পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে মেয়েরা এই সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করছে তা একটা গভীর চিন্তার বিষয়।

সচরাচর মনে করা হয়, বস যদি নারী হন, তাহলে হয়তো মেয়েলি সমস্যাগুলো তারা বুঝতে পারেন। এটা একেবারেই ভুল ধারণা, ক্ষমতায় গেলে অনেক সময় নারীরাও হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক।

এ ধরণের সমস্যায় দু-একজন নারী বসকে বলতে দেখেছি, ‘কই পিরিয়ডের সময় আমার তো অফিসে আসতে কোনো সমস্যা হয় না, তোমার এত সমস্যা হয় কেন?’

আমরা ভিন্নতা বা প্রতিটি মানুষ যে একজন আরেকজনের চেয়ে আলাদা, সে বিষয়টা মানতে চাই না। এটা একটা গুরুতর সমস্যা। আমি এমনও অনেক মেয়ের কথা শুনেছি, ঋতুকালীন সময়ে খুব সামান্যই অস্বস্তি বোধ করেন, তারা দিব্যি হাঁটা-চলা, এমনকি দৌড়াদৌড়িও করতে পারেন।

কেউ কেউ আবার পিরিয়ড চলাকালীন প্রথম দুদিন বিছানা ছেড়েই উঠতে পারে না। পেটের ব্যথা কমানোর জন্য সারাদিন পেটে গরম পানির ব্যাগ নিয়ে শুয়ে থাকেন।

কেউ কেউ বমি করেন, কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যান। কেউ কেউ পিরিয়ড শুরু হওয়ার দুদিন আগে থেকে বুঝতে পারেন, দুদিন পরে তার পিরিয়ড শুরু হবে। কেউ কেউ বুঝতেই পারে না যে তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে।

দেখা গেল, অফিসে এসে হাঁটাচলা করছেন, এমন সময় একজন নারী সহকর্মী এসে কানে কানে বলে দিলেন, ‘এই মেয়ে, তোমার জামার পেছনে কীসের দাগ?’

লেখিকার ছবি, তার ফেসবুক থেকে নেয়া

আবার অনেকে আছে, যাদের নিয়মিত পিরিয়ড হয় না। দুই-তিন মাস পরপর হঠাৎ একদিন পিরিয়ড শুরু হলো, তো দশ-বারো দিন ধরে চলছেই। আমি বলবো না, অফিসে মেয়েরা এ ধরণের সমস্যায় পড়েন, এর কারণ পুরুষ সুপারভাইসরদের অজ্ঞতা। এটা গুগলের যুগ, গুগল করলেই সবকিছু জানা যায়।

আমি বলবো, এটা এক ধরণের পুরুষতান্ত্রিকতা। মাসের পর মাস কর্মস্থলে নানা অজুহাতে মেয়েরা এই অস্বস্তিকর দিনগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার অজুহাত খুঁজছে। আর এই সুযোগে পুরুষ সুপারভাইসররা নারী কর্মীদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অযোগ্য প্রমাণে সফল হচ্ছে।

ফলে বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি সব ক্ষেত্রেই নারী কর্মীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। অথচ, পুরুষের এ ধরণের শারীরিক সমস্যা নেই, তারপরও পুরুষরা কিন্তু ঠিকই নানা অজুহাতে ছুটি নিচ্ছে।

আমি বেশ কিছুদিন অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি, পুরুষ সংবাদ কর্মীরাও প্রায়ই সকাল বেলা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিচ্ছে, কেউ কেউ আবার অ্যাসাইনমেন্টের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঘুম থেকেই উঠতে পারে নাই।

এমনও সময় গিয়েছে, যখন বৃষ্টির দিনে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য আমার পুরুষ সহকর্মীটি সময় মতো পৌঁছতে পারেনি, তার হয়ে আমি গিয়েছি ওই অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে। কিন্তু, অদক্ষ প্রমাণের বেলায় নারী কর্মীকেই বেছে নেয় পুরুষ সুপারভাইসররা।

এ কারণেই হয়তো, অফিসে অফিসে উঁচু পদগুলো দখল করে বসে আছে পুরুষরা। অথচ, গবেষণা বলছে, নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি পরিশ্রমী। এই সমস্যাটার মূলে রয়েছে, মেয়েদের এই ঋতুকালীন সময়টাকে স্বীকৃতি না দেয়া।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, গর্ভবতী নারীরা এখন বাংলাদেশে ছয় মাসের সবেতন ছুটি পাচ্ছে, কারণ সেটি সরকারিভাবে স্বীকৃত। মেয়েদের ঋতুকালীন সময়টাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বলেই এ সমস্যা বাড়ছে।

অথচ, এশিয়ার অন্যান্য দেশের দিকে তাকান, অনেক আগেই সেসব দেশে সবেতন ঋতুকালীন ছুটি দেয়া শুরু হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ান নারীরা দুদিনের ঋতুকালীন ছুটির আবেদন করতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই নারীর জন্য ঋতুকালীন ছুটি দেয়া শুরু করে জাপান।

তাইওয়ান ২০১৩ সাল থেকে তিন দিনের ঋতুকালীন ছুটি দেয়া শুরু করে আর ২০০১ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এই ছুটি দেয়া শুরু করে। ২০১৬ সাল থেকে চীনের কোনো কোনো সংস্থা নারীর জন্য ঋতুকালীন ছুটি দেয়া শুরু করে।

অত দূরেও যেতে হবে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও দুটি সংস্থা সম্প্রতি তাদের নারী কর্মীদের সবেতন ছুটি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশের নারীদের?

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এখন দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি দিচ্ছে, আগে এই ছুটি ছিল মাত্র একদিন।

আমি বলবো, একজন কর্মীর দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ার চেয়ে একজন ঋতুমতী নারীর ঋতুকালীন ছুটি পাওয়া অনেক জরুরি।
কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা। প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা কি চাইবে, নিজের আরামের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি বন্ধ করে, নারীদের ঋতুকালীন ছুটি দিতে?

তবে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কর্মীদের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি দেয়ার পাশাপাশি নারীদের ঋতুকালীন ছুটি দিতে পারে, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এ সবই নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটি কতটা নারীবান্ধব, তার উপর।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!