• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরে শহীদদের উত্তরসূরিদের প্রাপ্ত ও প্রাপ্যতা


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৬, ২০১৬, ০২:১৬ পিএম
একাত্তরে শহীদদের উত্তরসূরিদের প্রাপ্ত ও প্রাপ্যতা

বাদল বিহারী চক্রবর্তী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী এদেশের আপামর জনতা যে সকল আদর্শ, দর্শন ও আশা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তা নানাবিধ কারণে যেমন কিছু কাজে স্বার্থবাদী পাকিস্তান প্রিয় এদেশী দালাল, সেদেশ ও আন্তর্জাতিক মোড়লের পরোক্ষ হস্তক্ষেপে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে সেই সমস্ত আদর্শ ও দর্শন ব্যর্থ করে তাদের পরাজয়ের গ্লানি দূর করতে তাঁরা মরিয়া হয়ে ওঠেছিলেন এবং সক্ষমও হয়েছিলেন। কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুধীজনের ধারণা বঙ্গবন্ধু শাহাদত বরণ করার পর থেকে প্রায় আড়াই যুগের শাসনামলে বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক ছাত্র ব্যক্তিত্ব তখনকার বিসিএসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্র ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা থাকা ও দূরদর্শিতার অভাবে নিয়োগ পেতে সক্ষম হন। বিশ্লেষকগণ বুঝাতে চেয়েছেন, সে সময়গুলোতে অন্তরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিশালী নীতি পোষণ করলেও তাঁদের বাহ্যিক আচার-আচারণও ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদের পোশাক ও স্লোগানে Proliberation এর একনিষ্ঠ বাহক বলে মৌখিক পরীক্ষায় প্রমাণ দেয়ার এক সফল অভিনয় করেছিলেন। এমনকি, ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরও এক কথায় বলা যায়, যেকোন প্রকারে বোর্ডের প্রশ্নকর্তা ব্যক্তিদেরকে উনারা নিজেদের ‘জয় বাংলা’র ঘরানার লোক বলে বোর্ডের সদস্যদের সদয় অবগতিতে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে যা হবার, তাই হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেই ধরনের মানসিকতার বিভিন্ন ক্যাডার বিভিন্ন সেক্টরে এমন অনেক ব্যক্তিবর্গই সমাসীন হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। আমি বলছিনা যে, উনারা সে সমস্ত পদের উপযুক্ত নন। ব্রেইন উনাদের ভালই ছিল। কিন্তু absolute স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী চাকরীপ্রার্থীদের মগজও ভাল। তবু উপযুক্ত স্থানে অনেকের ভাগ্যের শিকা ছিঁড়েনি। এই না পাওয়ার ব্যর্থতা শুধু প্রার্থীদের নয়। একথা অনস্বীকার্য যে, সেই সব গুরুত্বপূর্ণ পদে ভাগ্যবান কোন কোন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব এদেশের নির্বাচনের (বিশেষ করে সাধারণ নির্বাচনে) কোন না কোন স্থানে পড়তেই পারে। দীর্ঘ ২৫/২৬ বছরে আমরা তা উপলব্ধি করেছি। এক সাগর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ বাহ্যিকভাবে লোক দেখানো হলেও পুরো অধ্যায়টাই তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর ও উৎকট লাগতো। তবুও দেশের হাজারো স্বাধীনতাপন্থী ভাবুক ও শুভানুধ্যায়ীদের মতো আমি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মজনহারা মানুষ হয়েও নিজেদের ত্রুটি আগে দেখে নিতে চাই। আমরা যদি সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার মর্মবাণী ও আত্মোপলব্ধি প্রচার দেখতে চাই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্বাধীনতার সুফল ও স্বাক্ষর রাখার পূর্বাপর ধারায় অবগাহন করতে চাই; তাহলে আমাদের কাজে-কর্মে, অফিস-আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি উপসনালয়ের করিডোর পর্যন্ত নির্ভেজাল উদারনৈতিক সত্যিকার স্বাধীনতাপন্থী মানব ও মানবীর কীর্তি পদচারণা ও মুখরতায় ভরে রাখা জরুরি বলে প্রাজ্ঞ সুধীজনের মতো আমারও সেরকম ধারণা।
আজ একটা বিষয় প্রসংশনীয় যে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও উত্তরসুরিগণ কাঙ্খিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষাসহ চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ কোটার সুবিধা পেয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধা ও যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাগণ নির্ধারিত হারে ভাতা পেয়ে আসছেন। তবুও এখানে একটি আক্ষেপ থেকেই যায় সেটা হলো, অস্ত্র হাতে না নিয়েও যুদ্ধের নয় মাস অজস্র মুক্তি ও স্বাধীনতার ব্রতধারী মানুষ তাদের বাড়িঘর খালি করে দিয়ে অপেক্ষাকৃত অজ পাড়াগাঁয়ের বিদ্যালয়ে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঢাকে প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা যাঁরা যুদ্ধের নয় মাস অব্যাহত রেখে আসছিলেন; সর্বোপরি ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দু’লক্ষ সম্ভ্রম হারা মা-বোনদের উত্তরসুরিগণ আজ কী অবস্থায় আছেন, মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসুরিদের মতো সে সমস্ত স্বজন হারাদের জন্য কোন ধরনের কোটা থাকা উচিত কিনা, তা আজ অনেকের প্রশ্ন। তেমন একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি আমার কথাই বলি। আমার শহীদ পিতা বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী ছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভালুকা থানার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ করে, নাট্য জগতের একজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। বাবার আশা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একখানা নাটক লিখবেন বলে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত একখানা ডায়েরিতে তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন প্রতিদিন। এ প্রসঙ্গে বাবার কিছু সৃষ্টি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করলেও আশা করি সম্মানিত পাঠকদের বুঝতে সহজ হবে যে, আমার স্বর্গীয় পিতাকে কোন উচ্চতর স্কেলে পরিমাপ করলে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়। তাঁর পঠিত ও সংগৃহীত অগণিত দুর্লভ বই এবং নিজের লেখা যে সমস্ত যাত্রা ও নাটকের সর্বস্ব পাণ্ডুলিপি সেদিন ভস্মীভূত হয়ে যায়, যেদিন আমাদের বাড়িতে পাকহানাদার ও রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে। তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপিসমূহ যেগুলোর নাম এ মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে সেগুলো হলো-
১) জনক নন্দিনী          (পৌরাণিক যাত্রা)
২) রাবন বধ                 ঐ
৩) প্রতিজ্ঞা পালন             ঐ
৪) মুক্তি সাধনা            (ঐতিহাসিক যাত্রা)
৫) হারানো মানিক        (সামাজিক নাটক)
৬) ভক্ত প্রহ্লাদ            (ছোটদের পৌরাণিক যাত্রা)
৭) গফুর বাদশাহ্ ও বানেছাপরী     (কিস্সা অবলম্বনে)
সংস্কৃতির নানামুখী ধারা যেমন-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, পালাগান, হুলিগান, নৌকা বিলাস ও নিমাই সন্ন্যাস ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে বাবার যে একাধিক পঠন ও প্রজ্ঞা ছিল, তা বুঝা যায় যখন ভালুকা-গফরগাঁও অঞ্চলের স্কুল-কলেজের সাহিত্যানুরাগী শিক্ষক ও নানা শ্রেণী পেশার শিক্ষিত লোকজন বাবার সান্নিধ্যে এসে বিস্তর জটিল ও দুর্বোধ্য সাহিত্যের মর্মার্থ জেনে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন তখন।
সুধী পাঠক, আমি সবিনয়েই জানাচ্ছি যে, মূল বিষয়বস্তু হতে আমি হয়তো প্রসঙ্গান্তরে অনেক দূর চলে এসেছি। আমার শহীদ ছোট ভাইয়ের কথা এ নিবন্ধে আজ না-ই বা লিখলাম। তবে, শুধু এটুকুই বলতে চাই, বহুমুখী গুণের অধিকারী ব্যক্তিদের আত্মোৎসর্গ কি অপূরণীয় ক্ষতি নয়? যদি অনস্বীকার্যই হয়ে থাকে যে এ ধরনের আত্মত্যাগ অপূরণীয়, তবে তাঁদের উত্তরসুরিগণ কেন আজও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সমতূল্য হতে পারছে না? আপাদমস্তক বাঙালি চেতনা ও স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুকে লালন করেও কেন শতকরা ৮০ পাওয়া সন্তানকে শতকরা ৬০ পাওয়া সন্তানের জন্যে আসন ছেড়ে দিতে হয়। আমি বরাবরই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটা রাখার পক্ষপাতি। পাশাপাশি এ দেশের যে ত্রিশ লক্ষ শহীদের সন্তানরা আজ উপযুক্ত, শুধুমাত্র সেইসব ভাগ্যহীন উত্তরসুরিদেরও অধিকার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সমতুল্য কোটা সৃষ্টি করার প্রত্যাশা করছি।
শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে আমরা জাতির বিবেকের স্মৃতিচারণ করি। সে সমস্ত অমূল্য জীবন হারানোর ক্ষতি আমরা কত দিনে কাটিয়ে ওঠতে পারবো জানি না। তাঁদের অনেকের সন্তানদের দেখি বিভিন্ন গণমাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় পারিপার্শ্বিক পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বমহিমায় আজ তাঁরা নানা ক্ষেত্রে উপযুক্ত পেশায় নিয়োজিত। তাঁদের কর্মপরিধি, পেশাগত দায়িত্ব ও রাজনৈতিক চেতনা আজ দেশ-দেশান্তরে বিধৃত হয়ে আছে। শহীদ সন্তান হিসেবে আমিও তাঁদের সাথে একাত্ম।
পরিশেষে আমার এটুকুই বলা যায় যে, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি যতটুকুই থাক, একাধিক গুণসম্পন্ন নিরস্ত্র শহীদ ব্যক্তিত্ব হয়তো আমার বাবার মতো আরও ছিল এদেশে, যে নামগুলোর আদৌ স্মৃতিচারণ হয়না বা তাঁদের উত্তরসুরিগণ এখনও দিগভ্রান্তের মতো বিশাল কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষার কোটা হতে সাধারণ মানুষের মতো ছিটকে রয়েছে। কোটা সিস্টেমের সেই সোনার হরিণের কি আদৌ নাগাল পাওয়া যাবে, আমার বা আমার মতো অগণিত ভাগ্যাহত সন্তান ও উত্তরসুরিদের হাতে? নাকি স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয় চেতনাবোধ তাদের কাছে কেবল ‘পাখির পেটের ভিতর পুঁথির শুক্নো পাতার মতো খস্খস্  ঘজঘজ করিতে থাকিবে’; নাকি পূর্ণিমার চাঁদকে সুকান্তের ঝলসানো রুটি দেখার মতো দুর্ভাগ্য ও হতাশা নিয়ে জীবন সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে?

Wordbridge School
Link copied!