• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একের পর এক সৌদি রাজপুত্র কেন নিখোঁজ হচ্ছেন?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক আগস্ট ১৬, ২০১৭, ০২:১৫ পিএম
একের পর এক সৌদি রাজপুত্র কেন নিখোঁজ হচ্ছেন?

নিখোঁজ রাজপুত্রদের ছবি

ঢাকা: মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে গত এক দশকের মধ্যেই তিনজন রাজপুত্র অপহরণের শিকার হয়েছেন। যাদের খবর এখনো জনা যায়নি। তবে এর জন্য সৌদি রাজতন্ত্রকেই দায়ী করছেন তাদের স্বজনরা।

বিবিসির এক তদন্তে উঠে এসেছে যে রাজতন্ত্রের বিরোধীতা করার জন্যই তাদের নিখোঁজ করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি ভিন্ন মতাবলম্বী এক সৌদি রাজপুত্রকে অপহরণ করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিমা সাক্ষী এই বিষয়ে কথা বলেছেন। এরা গত বছর প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কী বিন আব্দুল আজিজের এক সফরের সঙ্গী ছিলেন।

তারা ভেবেছিলেন বিমানে চড়ে তারা ফ্রান্স থেকে মিশরে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রাইভেট জেট বিমান অবতরণ করে সৌদি আরবে। এরপর থেকে যুবরাজের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই অভিযোগের ব্যাপারে সৌদি সরকার মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বিবিসির সংবাদদাতা রেদা আল মাওয়ি বলছেন, ইউরোপে বাস করতেন এমন তিনজন সৌদি যুবরাজ গত দু'বছরে নিখোঁজ হয়েছেন।এরা তিনজনই সৌদি সরকারের সমালোচক ছিলেন।

মাঝে প্রিন্স সুলতান

এমন প্রমাণ আছে যে এই তিনজনকেই অপহরণ করা হয়েছে এবং বিমানে করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে - এবং তার পর থেকে এদের কোন খোঁজখবর পাওয়া যায় নি।

জেনেভা শহরের উপকণ্ঠে ২০০৩ সালের ১২ই জুন একজন সৌদি প্রিন্সকে গাড়িতে করে একটি প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সুলতান সংজ্ঞা হারালেন। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো জেনেভা বিমানবন্দরে। সেখানে অপেক্ষা করছিল একটি বিমান। অনেক বছর পর সুলতান সুইজারল্যান্ডের এক আদালতে এ ঘটনার বর্ণনা দেন।

প্রিন্স সুলতান কি করেছিলেন যে তার পরিবারের লোকেরাই তাকে এভাবে অপহরণ করলো?

এর আগের বছর ইউরোপে চিকিৎসার জন্য এসে প্রিন্স সুলতান সৌদি সরকারের মানবাধিকার রেকর্ড, যুবরাজ ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সমালোচনা করে কিছু সাক্ষাৎকার দেন, এবং কিছু সংস্কারের আহ্বান জানান।

সৌদি আরবে ১৯৩২ সালে বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই দেশটি একটি রাজতন্ত্র এবং এখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না।

রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে প্রভাবশালী প্রিন্স তুরকি বিন বান্দার এর আগে জেল খেটেছেন। ছাড়া পাবার পর তিনি প্যারিসে পালিয়ে যান এবং সৌদি আরবে সংস্কার দাবি করে ইউটিউবে ভিডিও ছাড়েন।

২০০৩ সালে তৎকালিন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রিন্স তার্কি

তখন তার ওপর চাপ দেয়া হয় দেশে ফেরার জন্য। তাকে ফোন করেন ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ আল-সালেম। সেই টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করে রাখেন প্রিন্স, এবং পরে তা অনলাইনে প্রকাশ করেন। আলাপটি ছিল এই রকম:

‘সবাই আপনার প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে। জাযাকআল্লাহ খায়ের।’ “আমার ফেরার জন্য? তোমার অফিসাররা যে আমাকে চিঠি লিখেছে বেশ্যার সন্তান, তোকে আমরা সুলতান বিন তুরকির মতো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবো।”

‘ওরা আপনার গায়ে হাত দেবে না’- ডেপুটি মন্ত্রী আশ্বাস দিলেন। তুরকি বললেন, ‘না, ওরা তোমারই লোক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওদের পাঠায়।’

প্রিন্স তুরকি ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ভিডিও পোস্ট করেন। তার কিছুদিন পরই তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে যান।

সৌদি ব্লগার ওয়ায়েল আল-খালাফ বলেন, ‘পরে আমি একজন কর্মকর্তার কাছে শুনেছি যে তুরকি বিন বান্দার তাদের সাথেই আছেন। তার মানে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে মরক্কোর এক পত্রিকায় দেখেছি তাকে মরক্কোতেই গ্রেফতার করা হয়, এবং সৌদি আরবের অনুরোধে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’

একই সময় প্রিন্স সৌদ বিন সাইফ আল-নাসর নামের আরেক জন যুবরাজেরও একই পরিণতি হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাসিনো এবং ব্যয়বহুল হোটেল পছন্দ করতেন। ২০১৪ সালে তিনি সউদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে টুইট করতে শুরু করেন।

তার ভাষায় যেসব সৌদি কর্মকর্তা মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোরসিকে উৎখাত করায় সমর্থন দিয়েছিলেন - তাদের বিচার দাবি করেন তিনি।

এর পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আরো দুঃসাহসিক কাজ করেন। বাদশাহ সালমানকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়ে দুটি চিঠি লেখেন এক অজ্ঞাত যুবরাজ, এবং প্রিন্স আল-নাসর তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। রাজপরিবারে কেউ এর আগে এ কাজ করেন নি, এবং এটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এর কয়েকদিন পরই তার টুইটার একাউন্টটি নিরব হয়ে যায়।

প্রিন্স খালেদ বিন ফারহান নামে আরেকজন ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি যুবরাজ খালেদ বিন ফারহান ২০১৩ সালে জার্মানি পালিয়ে যান। কিন্তু সেখান থেকে তাকে কৌশলে রিয়াদে নিয়ে যায় সম্ভবত সৌদি গোয়েন্দারা - বলেন ব্লগার আল-খালাফ।

ইতিমধ্যে বন্দী অবস্থায় প্রিন্স সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়ায় ২০১০ সালে রাজপরিবার তাকে আমেরিকার বস্টন শহরে চিকিৎসার জন্য যাবার অনুমতি দেয়। আর সেখান থেকেই প্রিন্স সুইস কোর্টে এক মামলা ঠুকে দেন - এবং তাতে তিনি তাকে অপহরণের জন্য প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন ফাহদ, এবং শেখ সালেহ আল-শেখকে দায়ী করেন।

তবে সুইস সরকার এ মামলায় তেমন কোন উৎসাহ দেখায় নি। কিভাবে সুইস বিমানবন্দর থেকে তাকে বিমানে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো তার তেমন কোন তদন্তও হয় নি।

গত বছর জানুয়ারি মাসে সুলতান ছিলেন প্যারিসের একটি হোটেলে। তিনি কায়রোতে তার বাবাকে দেখতে যাচ্ছিলেন। তখন সৌদি কনস্যুলেট তার যাত্রার জন্য একটি প্রাইভেট জেট বিমান দেবার প্রস্তাব দেয়। ২০০৩ সালের ঘটনা সত্বেও প্রিন্স তা গ্রহণ করেন। তার সাথে ছিলেন তার নিজস্ব ডাক্তার এবং প্রায় ইউরোপীয় ও আমেরিকান দেহরক্ষী সহ ১৮ জন লোক।

পরে - নাম প্রকাশ না করার শর্তে - ওই দলের দুজন বর্ণনা করেছেন যে বিমানে কি হয়েছিল।

‘আমরা একটি বিশাল বিমানে উঠলাম, তার গায়ে সৌদি আরবের নাম লেখা ছিল। আমরা দেখলাম তাতে প্রচুর ক্রু আছেন, এবং তারা সবাই পুরুষ। আমাদের কেমন যেন লাগলো।’

‘বিমানের ভেতরে মনিটরে দেখা যাচ্ছিল আমরা কায়রো যাচ্ছি। কিন্তু আড়াই ঘন্টা পর মনিটরগুলো অন্ধকার হয়ে গেল।’

‘প্রিন্স সুলতান ঘুমোচ্ছিলেন, তবে ল্যান্ডিংএর এক ঘন্টা আগে তিনি জেগে উঠলেন। জানলা দিয়ে তাকালেন। তাকে উদ্বিগ্ন মনে হলো।’

‘আরোহীরা যখন বুঝতে পারলেন যে তারা সৌদি আরবে অবতরণ করতে যাচ্ছেন, তখন সুলতান ককপিটের দরজায় বার বার করাঘাত করতে লাগলেন, সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলেন। ক্রুদের একজন প্রিন্সের সঙ্গীদের সিটে বসে থাকতে বললো।’

বিমান নামার পর রাইফেলধারী কিছু লোক বিমানটি ঘিরে ফেললো। সৈন্য এবং কেবিন ক্রুরা মিলে সুলতানকে বিমান থেকে টেনে হিঁচড়ে নামালো। তিনি চিৎকার করে তার দলকে বলছিলেন আমেরিকান দূতাবাসে ফোন করতে।

প্রিন্স খালিদ

প্রিন্স এবং তার চিকিৎসকদের একটি ভিলায় নিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় আটকে রাখা হলো। তার সফর সঙ্গীদের তিনদিন হোটেলে আটকে রাখার পর যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হলো।

এ ঘটনার পর থেকে প্রিন্স সুলতানের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। এই অপহরণের অভিযোগের ব্যাপারে সৌদি সরকার মন্তব্য করতেও অস্বীকার করে।

প্রিন্স খালেদ যিনি এখনো জার্মানিতে আছেন, আশংকা করছেন তাকেও একদিন জোর করে রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হবে। তার কথা, সৌদি রাজপরিবারের সমালোচনা করেছে এমন ওই পরিবারের চারজন সদস্য ইউরোপে ছিল।

তিনি বলেন, ‘তিনজনকে অপহরণ করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু আমিই বাকি।’

এর পর কি তার পালা?

‘আমি নিশ্চিত যে তাই। অনেক দিন ধরেই। তারা যদি পারতো এতদিনে কাজটা করেও ফেলতো। আমি খুবই সাবধানে থাকি, তবে এটা আমার স্বাধীনতার মূল্য।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর

Link copied!