• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এতিমখানাতেই শিশুরা এতিম!


বিল্লাল হোসেন রাজু এপ্রিল ৩০, ২০১৮, ০৫:০৫ পিএম
এতিমখানাতেই শিশুরা এতিম!

ঢাকা : পিতৃ-মাতৃহীন নিঃসঙ্গ শিশুদের শেষ ঠিকানা ‘এতিমখানা’। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এতিম শিশুদের শেষ ঠিকানা এতিমখানা হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। বলা যায় ‘এতিমখানাতেই শিশুরা এতিম!’

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় জনগণই এতিম শিশুদের লালন-পালনের জন্য বেসরকারিভাবে এতিমখানা পরিচালনা করে আসছে। বেসরকারি এ সকল এতিমখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন প্রাপ্ত বেসরকারি এতিমখানাসমূহের শিশুদের প্রতিপালন, চিকিৎসা এবং শিক্ষা প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা করা হয় যা ক্যাপিটেশন গ্রান্ট নামে পরিচিত। বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বেসরকারি এতিমখানার প্রায় ৬২ হাজার এতিম শিশুকে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রদান করা হচ্ছে। দরিদ্র এতিম শিশুদের মানবসম্পদে পরিণত করাই ক্যাপিটেশন গ্রান্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও অধিকাংশ এতিমখানাগুলোতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এতিম শিশুরা। ফলে এসব শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিনিয়িতই এতিম শিশুদের সেবা দানের জন্য বাড়ছে বেসরকারি এতিমখানার সংখ্যা। এতিমখানা বাড়লেও হুজুরদের মানসিক বিকাশের বৃদ্ধি ঘটেনি বলে মনে করছেন বিষেশজ্ঞরা। ফলে বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের হাতেই এসব শিশুদেরকে যৌন নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়।

গত এক বছরে সারা দেশের বেশ কয়েকটি এতিমখানায় নিয়োজিত হুজুরদের হাতে অসহায় এতিম শিশুরা শারীরিক ও মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে টেনে-হিঁচড়ে পায়ের নিচে ফেলে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে নির্যাতন করেছেন এতিমখানার শিক্ষক। তখন ওই ঘটনার ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় নির্যাতনের শিকার হয়েছিল গাজীপুর পূবাইল রহমানিয়া এতিমখানা মাদ্রাসার ছাত্র তাওহীদুল ইসলাম।

অন্যদিকে এতিম শিশুদের বিকৃত যৌন নিপীড়ন ও ঠিকমতো খেতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে একত্রিত হয়ে চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ক্ষিপ্ত হয়ে পিটিয়েছে সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবারের ৭২ শিক্ষার্থী। গত ৫ জানুয়ারি এতিমখানায় শিশুকে অমানসিক নির্যাতন করে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট চিস্তিয়া হাফেজিয়া এতিমখানার হুজুর মো. রহিম। ওই ঘটনায় গুরুতর এতিম শিশু জিহাদ।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেশের বেশিরভাগ এতিমখানাতে শিশুরা অনিরাপদ এবং বন্দি জীবন পার করে। কেননা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এতিমখানার শিক্ষকরা নিজেদের পকেট ভারি করতে ব্যস্ত থাকেন। এসব অনিয়ম আর অমানবিকতার বিষয়ে যাতে শিশুরা মুখ না খুলে সেজন্য শিশুদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এতিম শিশুদের পরির্বতে দায়িত্বরত হুজুরদের আত্মীয়-স্বজনদের শিশুরা এতিম শিশুদের সুবিধা নিয়ে থাকে। এতিম শিশুদের উপযুক্ত সুবিধা না দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দকৃত টাকা লুটপাট করছে কমিটি ও হুজুরা।

জানা যায়, দেশে বর্তমানে দুই ধরনের এতিমখানা চালু রয়েছে, ‘মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘লিল্লাহ বোর্ডিং’ এতিমখানা এবং স্বতন্ত্র এতিমখানা’। যেখানে আশ্রয় প্রতিপালনসহ এতিম শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সরকারি শিশুসদন নামে সরকার পরিচালিত এতিমখানা। সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বেসরকারি এতিমখানা রয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সমাজ সেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে বেসরকারি এতিমখানার ৫-৯ বছর বয়সী এতিম দরিদ্র শিশুর শতকরা ৫০ ভাগ শিশু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, যেসব ভাগ্যবিড়ম্বিত অনাথ শিশু এখানে ঠাঁই নিয়েছে, তারা চরম অবহেলা ও দুরবস্থার শিকার। দেশের অনেক এতিমখানায় স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গোডাউনের মতো কক্ষ শিশুদের থাকার জায়গা। বেশিরভাগ এতিমখানায় একটি মাত্র শৌচাগার। খাওয়া-দাওয়া অতি নিম্নমানের। তাছাড়া বেসরকারি এতিমখানার নামে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সরকারি বরাদ্দের টাকা অবাদে লুটপাট হচ্ছে। মাদ্রাসাভিত্তিক এসব এতিমখানায় কাগজে কলমে এতিম থাকলেও বাস্তবের সঙ্গে এর মিল নেই। বসবাসের অযোগ্য ঘরের সামনে নাম সর্বস্ব লিল্লাহ বোডিং সাইনবোর্ড দিয়ে হাফেজি পড়া ছাত্রদের এতিম বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ এতিমখানাগুলোতে সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থের চরম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আছে।

এ ব্যাপারে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান অধিশাখা পরিচালক (প্রতিষ্ঠান)  মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কিছু কিছু অনিয়মের কথা আমরা জেনেছি। মানবিক কারণে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এতিমখানা বা সরকারি শিশু পরিবারে এতিম শিশুরা থাকবে সবচেয়ে নিরাপদে। আমাদের চেষ্টা চলছে দুর্নীতি এবং অসাধু হুজুরদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপের ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম মহিউদ্দিন দীপু বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। তাই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।

অসহায় এতিম শিশুর মানসিক বিকাশ নিয়ে ঢাকা শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম মনিরুজ্জোহা বলেন, এতিম শিশুরা এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা, শিশুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়ে তোলা, দরিদ্রতা শিশুর নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। তিনি আরো বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে একজন মানুষ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না, কেননা শরীর ও মন একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এতিম শিশুদের মানসিক বিকাশে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!