• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনজিওগুলো বেশুমার সম্পদের মালিক, তথ্য নেই কর্তৃপক্


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১০, ২০১৬, ০১:০৩ পিএম
এনজিওগুলো বেশুমার সম্পদের মালিক, তথ্য নেই কর্তৃপক্

সোনালীনিউজ রিপোর্ট

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিবন্ধন নিলেও এদেশে কর্মরত বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো (এনজিও)। নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি এনজিওগুলো হাজার হাজার একর জমিরও মালিক। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সে ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য নেই।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এনজিগুলোর সম্পদের সঠিক হিসাব সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে থাকা জরুরি। কারণ হদরিদ্রদের সঞ্চয় ও শ্রমে গড়ে ওঠা এনজিওগুলোর নানা ধরনের লাভজনক ব্যবস্থায় জড়িয়ে পড়া এবং সম্পদের সম্পদের তথ্য জানার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে।

এনজিওগুলো তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয় না। আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ওসব সংস্থার লাভজনক ব্যবসায় বেশি আগ্রহী হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঠ্যাঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) বগুড়ার নওদাপাড়ায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে তিন তারকা হোটেল মমো ইন গড়ে তুলেছে। রয়েছে দুটি সিএনজিও স্টেশনও। পাশাপাশি সারা দেশে এই সংস্থাটির সাড়ে ৩ হাজার বিঘা জমি এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্কুল ও মাদ্রাসা রয়েছে। একইভাবে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রেরও রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি ও অনেকগুলো বহুতল ভবন। ব্র্যাকের রয়েছে সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ খাতের একাধিক প্রতিষ্ঠান। আর আশার রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্থায়ী সম্পদ। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যই সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।

সূত্র জানায়, অলাভজনক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর লাভজনক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া এবং বেশুমার সম্পদ আহরণের বিষয়ে সরকারি সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) বলছে, নিবন্ধন দেয়াই মূলত তাদের কাজ। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) দাবি─ শুধু মাত্র ক্ষুদ্রঋণের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে নির্ধারিত সীমার বাইরে স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা সেটি দেখাই তাদের দায়িত্ব। আর এনজিও ব্যুরো বলছে, বিদেশি অনুদানের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই তাদের কাজ।

সূত্র আরো জানায়, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও খুলনা অঞ্চলে টিএমএসএসের ৪১টি নিজস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই দু-তিন তলাবিশিষ্ট। আর ঢাকায় রয়েছে তিন তলাবিশিষ্ট মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। মিরপুরের প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবনটিও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব। বগুড়ায় রয়েছে টিএমএসএসের ১৩ তলাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ এবং ১৮ তলাবিশিষ্ট টিএমএসএস হাসপাতাল। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি দাখিল মাদ্রাসাও চালু করেছে। তবে টিএমএসএস সিএনজি স্টেশনের মালিকানা এনজিওর নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগমের ছেলের নামে দেয়ায় তা নিয়ে আপত্তি তোলে এমআরএ। একাধিকবার এ নিয়ে শুনানিও হয়েছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। দেশজুড়ে প্রশিকার রয়েছে ২২১টি শাখা অফিস। তার মধ্যে নিজস্ব মালিকানায় রয়েছে শতাধিক বহুতল অফিস। তাছাড়া ঢাকা অফিসেরই জমির পরিমাণ দশমিক ৪৫ একর। পাশাপাশি মানিকগঞ্জে ৩৪ একর, সাতকানিয়া ফার্মে ১৯ একর, রংপুর ফার্মে ৩৮ একর ও খুলনা শিরোমনিতে ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ জমি রয়েছে। উন্নয়ন এলাকাগুলোয় জমির পরিমাণ ৩১০ দশমিক ৪১ একর।

সব মিলিয়ে এনজিওটির মোট জমির পরিমাণ এক হাজার বিঘারও বেশি। আর দেশের শীর্ষস্থানীয় এনজিও ব্র্যাকের সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ খাতের একটি প্রতিষ্ঠান হলো আড়ং। সারা দেশে আড়ংয়ের ১৫টি আউটলেট রয়েছে। তারমধ্যে কিছু আছে নিজস্ব মালিকানাধীন। 

আড়ং ছাড়াও ব্র্যাকের অন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো─ ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক কোল্ড স্টোরেজ, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক ফিড মিলস, ব্র্যাক ফিশারিজ, ব্র্যাক নার্সারি, ব্র্যাক পোলট্রি, ব্র্যাক পোলট্রি রেয়ারিং, ব্র্যাক প্রিন্টিং প্যাক, ব্র্যাক রিসাইকেলড হ্যান্ডমেড পেপার, ব্র্যাক সল্ট, ব্র্যাক স্যানিটারি ন্যাপকিন অ্যান্ড ডেলিভারি কিটস ও ব্র্যাক সিডস। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ব্যাংকেও এনজিও ব্র্যাকের শেয়ার রয়েছে।

সারাদেশে ব্র্যাকের তিন হাজার শাখা অফিস রয়েছে। ২০১৪ সালের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্র্যাকের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। দায়ের পরিমাণ ৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। ওই হিসাবে ব্র্যাকের নিট সম্পদ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর রাজধানীর শ্যামলীতে রয়েছে আশা টাওয়ার। সেখানে এনজিওটির মালিকানাধীন আশা বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়াও রয়েছে আশা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেইনিং স্কুল।

এদিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিবন্ধন নিয়েও এনজিওগুলো সাধারণ মানুষের টাকায় বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসায়ী জড়িয়ে পড়া বিষয়ে নিজেদেও অনুকূলে নানা যুক্তি তুলে ধরছে। লাভজনক ব্যবসায় জড়ানো এবং সম্পদ গড়ে তোলারর বিষয়ে টিএমএসএসের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক শাকিল বিন আজাদের মতে─ টিএমএসএস ক্ষুদ্র ঋণ বা অনুদানের অর্থ দিয়ে সম্পদ করেনি। এজন্য এমআরএ ও এনজিও ব্যুরোর কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়নি। বরং সব সম্পদই প্রতিষ্ঠানটির জনারেল ফান্ড থেকে করা হয়েছে।

সেজন্য এমআরএ বা এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। আর সম্পদ প্রসঙ্গে প্রশিকার উপপ্রধান নির্বাহী সিরাজুল ইসলাম জানান─ সংস্থাটির মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। কিছু সম্পদ অবৈধভাবে বিক্রি হয়ে গেছে আর কিছু দখলে রয়েছে। এনজিওর সম্পদ বিক্রি বা কিনতে হলে কোনো নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদন নিতে হয় না।

ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক (স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট) আসিফ সালেহ জানান, এমআরএ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদের তথ্য কখনো চায়নি বলে দেয়াও হয়নি। তবে ক্ষুদ্রঋণের তহবিল থেকে কোনো সম্পদ করলে তার অনুমোদন নেয়া হয়। তবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা যদি জেনারেল ফান্ড থেকে যেসব সম্পদ করা হয়েছে তার হিসাব চায় তাহলে তা দেয়া হবে।

তাছাড়া আশার রিসার্চ ও কমিউনিকেশন্স বিভাগের সহকারী পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, এনজিওটি আশা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো মুনাফা পায় না। নিজস্ব মুনাফা দিয়েই তারা চলতে পারে। তবে প্রয়োজন পড়লে মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে আশা যদি তার সোস্যাল এন্টারপ্রাইজকে আর্থিক সহায়তা করে তাতে সমস্যার কিছু নেই।

অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণদানকারী এনজিওগুলো জেনারেল ফান্ড থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ করলেও এমআরএ শুধুমাত্র নিজস্ব কিছু বিষয় দেখভাল করে। এ বিষয়ে এমআরএর পর্ষদ সদস্য ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী জানান─ শুধুমাত্র ক্ষুদ্রঋণের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে এনজিওগুলো নির্ধারিত সীমার বাইরে স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা তা দেখে থাকে এমআরএ। সম্প্রতি ক্ষুদ্রঋণের অর্থ নিয়ম ভেঙে অন্য খাতে বিনিয়োগের কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতেও ডাকা হয়েছে। আর বর্তমানে এনজিওগুলো বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ারর বিষয়ে এনজিও ব্যুরো, সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও আরজেএসসির দেখা উচিত। আর এনজিও ব্যুরোর বক্তব্য হচ্ছে বিদেশি অনুদানের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা। 

এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির পরিদর্শন ও নিরীক্ষা বিভাগের উপপরিচালক মো. শেখাবুর রহমান জানান, এনজিওগুলোর সম্পদের যাবতীয় তথ্য রাখার দায়িত্ব এমআরএর। তাছাড়া আরজেএসসির এক কর্মকর্তার মতে, এই সংস্থার কাজ শুধু নিবন্ধ দেয়া। এর চেয়ে বেশি কিছু করার মতো লোকবল বা সুযোগ কোনোটিই নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক আবু মোহাম্মদ ইউসুফ এই ব্যাপারে একই রকমের করেন।

সোনালীনিউজ/আমা

Wordbridge School
Link copied!