• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কঠিন শর্তের ঋণ, ঝুঁকিতে বিদ্যুৎখাত


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ৩০, ২০১৬, ১২:০১ পিএম
কঠিন শর্তের ঋণ, ঝুঁকিতে বিদ্যুৎখাত

কঠিন শর্তে ঋণে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। সহজ শর্তে দাতা গোষ্ঠিগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার কারণেই বিদ্যুৎ খাত ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন শর্তের ঋণের দিকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের কঠিন শর্তের ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন এবং অচিরেই তা মারাত্মক রূপ নেয়ার আশঙ্কা করছেন।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি নিরুপায় হয়েই কঠিন শর্তের ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ খাতের দ্রুত উন্নয়ন চাইলে কঠোর শর্তের ঋণ ছাড়া বর্তমানে উপায় নেই। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চাচ্ছে। সেজন্য ওই সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর ওই লক্ষ্য পূরণে গত ৭ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৮শ’ কোটি ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা।

২০২১ সালের মধ্যে আরো দেড় হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু এখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ মিলছে না। ফলে বাধ্য হয়েই বিদ্যুৎ বিভাগ কঠিন শর্তের এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির (ইসিএ) মাধ্যমে ঋণ নেয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেড়শ’ কোটি ডলার ইসিএ ঋণ নেয়া হয়েছে। আরো প্রায় ৪৮০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার বিষয় প্রক্রিয়াধীন।

তবে যেসব সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি ওসব ঋণ নিচ্ছে তাদের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা কম। ফলে বিদ্যুৎ খাতে এই ধরনের ঋণ ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দাঁড়াচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি খাতের প্রধান সংস্থা পিডিবিও ওই ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো এক প্রতিবেদনে পিডিবি ইসিএর মাধ্যমে অর্থায়নে ৫টি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। আর ঝুঁকি মোকাবেলায় একটি সংকট ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠনেরও পরামর্শ দিয়েছে পিডিবি। মূলত সরকারি খাতে বিভিন্ন কোম্পানি ওই ইসিএ ঋণ নিচ্ছে। ওসব কোম্পানির উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনে নেয়।

সূত্র জানায়, দাতাদের কাছ থেকে আগে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন শর্র্রে কারণে দাতাদের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ইসিএ ঋণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতের কঠিন শর্তের ঋণের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন অর্থ মন্ত্রণালয়ও।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বলা হয়, এই ধরনের ঋণ পরিশোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। ফলে ওই ঋণের বোঝা একটা পর্যায়ে সরকারের ঘাড়েই চাপতে পারে। তখন এটা নিয়ে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের আয় বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর নির্ভরশীল।

চাহিদা কমে যাওয়ায় শীতে বিদ্যুৎ বিক্রি গ্রীষ্মের তুলনায় অর্ধেক কমে যায়। অর্থাৎ শীতকালে আয়ও কমে যায়। তাতে একমাত্র ক্রেতা হিসেবে ঋণের দায় পড়বে পিডিবির ওপর। আর পিডিবির মতে উৎপাদন ব্যয় অনুসারে এখনো বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয় না। 

সম্প্রতি কয়েকবার দাম বাড়লেও উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যবধান অনেক। যার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর আয়ে। ঋণ পরিশোধে এটাও একটা বড় ঝুঁকি। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয় টাকা; কিন্তু ঋণ পরিশোধ করা হয় ডলারে। টাকার অবমূল্যায়ন হলে ঋণের দায়ভার বাড়বে।

সূত্র আরো জানায়, ইসিএ অর্থায়নে ৬ হাজার ৪১৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।  সেজন্য প্রায় ৬৩০ কোটি ডলার ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারমধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং সম্পন্ন হয়েছে। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎৎ কোম্পানির ৪৫০ মেগাওয়াট (দক্ষিণ) কেন্দ্র নির্মাণে ৪২ কোটি ডলার, পিডিবির শাহজীবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণে ২৩.৮ কোটি ডলার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ১১ দশমিক ৩ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে এইচএসবিসি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে সরকারকে।

আশুগঞ্জে ২২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ১৯ দশমিক ৩ কোটি ডলারের ঋণের বিপরীতে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে সভরেইন গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণে ২০ দশমিক ১ কোটি ডলার ও বড়পুকুরিয়ায় ২৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিট নির্মাণে ২২ দশমিক ৮ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নাকে (আইসিবিসি) গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।  আর কড্ডায় ১৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র নির্মাণে ১৩ দশমিক ৯ কোটি ডলার ঋণের জন্য এক্সিম ব্যাংক অব চায়নাকে সভরেইন গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার।

তাছাড়া আরো যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ইসিএ ঋণ নেয়া হচ্ছে সেগুলো হলো সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াটের জন্য ২০ দশমিক ৯ কোটি ডলার (স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক), ঘোড়াশাল ৩ ইউনিট রিপাওয়ারিংয়ের জন্য ২৫ দশমিক ৯ কোটি ডলার (এইচএসবিসি), বিবিয়ানা (৩) ৪৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ৩৪ দশমিক ৭ কোটি ডলার (জাপান ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল কোপারেশন), ঘোড়াশাল ৬নং ইউনিট রিপাওয়ারিংয়ের জন্য ২৮ দশমিক ৮ কোটি ডলার, রামপাল ১৩২০ কেন্দ্রের জন্য ১২০ কোটি ডলার, শাহজীবাজার ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ৭ দশমিক ৭ কোটি ডলার, হরিপুর ১০০ মেগাওয়াটের জন্য ১০ কোটি ডলার, খুলনা ২২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র্রের জন্য ৩২ দশমিক ১ কোটি ডলার এবং মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য ১৯৫ দশমিক ৭ কোটি ডলার।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য কঠিন শর্তেও ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিচ্ছে তাদের সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ। ওসব প্রতিষ্ঠানকে আয় করেই ঋণ শোধ করতে হবে। তাতে বিঘ্ন ঘটলে দায় চাপবে সরকারের কাঁধে। তাছাড়া দেশে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করে সে অনুসারে উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিদ্যুতের ওই চাহিদার প্রাক্কলনে হেরফের হলে অনেক কেন্দ্র বসে থাকবে। তখন বিদ্যুৎ বিক্রি হবে না। ফলে ঋণের বোঝা টানতে হবে সরকারকে। যা অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে ইসিএ অর্থায়ন বিষয়ে পিডিবি ৫টি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলছে, ‌ঋণগ্রহীতা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একমাত্র ক্রেতা পিডিবি। সুতরাং নগদ প্রবাহের (ক্যাশ ফ্লো) সব ঝুঁকির ক্রমপুঞ্জিত প্রভাব পিডিবির ওপরই পড়বে। কিন্তু ওই ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা পিডিবির নেই। তাতে পুরো দায় পরবর্তী সময়ে সরকারের ওপরই পড়বে।’

এরকম হলে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম জানান, উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিতে অর্থের প্রয়োজন। প্রচলিত উপায়ে ঋণ আর মিলছে না। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ বিক্রি করবে এবং ওই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। কোনো সমস্যা হবে না।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আমা
 

Wordbridge School
Link copied!