• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কমছে চাষের জমি, হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা


সোনালী বিশেষ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭, ০৩:৫০ পিএম
কমছে চাষের জমি, হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা

ঢাকা : দেশে দ্রুত কমছে ধান চাষের জমি। ধান চাষের পরিবর্তে কৃষকরা ক্রমে ধাবিত হচ্ছে মাছ, হাঁস-মুরগি চাষ, ফলের বাগানসহ নানা ধরনের বিকল্প ফসলের প্রতি।

এ ছাড়া দ্রুত নগরায়ন, বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ, ইটভাটাসহ আরো অনেক কারণে কমছে ধানের জমি। ধান চাষ বাদ দিয়ে কেউ পুকুর কেটে মাছ চাষ করছে। কেউ আবার আমড়া, আম, কলা, পেয়ারা, কুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফল চাষের দিকে ঝুঁকছে। এর কারণ অধিক লাভ। কৃষকেরা জানান, ধান চাষ করে আয় আসে না। যে খরচ হয় তা উঠে আসে না। অপর দিকে মাছ, হাঁস-মুরগি চাষ, ফলের বাগান এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদনে লাভ অনেক বেশি।
দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যেসব এলাকায় এক সময় মাইলের পর মাইল ধানের জমি ছিল সেখানে এখন আর তেমন ধানের জমি নেই।

এসব ধানের জমিতে এখন গড়ে উঠেছে সমন্বিত মাছ চাষ ও পোলট্রি ফার্ম প্রকল্প, ফলের বাগানসহ নানা ধরনের প্রকল্প। ধানের জমিতে পুকুর কাটাসহ বিভিন্ন প্রকল্প তৈরির যেন প্রতিযোগিতা চলছে অনেক এলাকায়। ধান চাষের পরিবর্তে সেখানে পুকুর কেটে মাছ, হাঁস-মুরগি চাষ করে কেউ একজন সফল হলে তার দেখাদেখি এলাকার অন্যরাও আগ্রহী হয়ে উঠছে একই ধরনের কাজে। ফলে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি।

বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৪৪ বছরে দেশে ধান চাষের জমি ১৮ শতাংশ কমেছে। তবে ধান চাষের জমি কমলেও একই সময়ে চালের উৎপাদন বেড়েছে তিন দশমিক ১৬ গুণ।

তবে ধানের জমি কমলেও বেড়েছে ধানের উৎপাদন। কিন্তু তাতেও দূর হচ্ছে না উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা যেভাবে ধানের জমি কমছে তা অব্যাহত থাকলে একসময় কমতে থাকবে ধানের উৎপাদনও। তখন হুমকির মুখে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা। এ ছাড়া বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ সঙ্কট ভয়াবহ রকমের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ বছর এপ্রিলে সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে হাওর বিপর্যয় এবং আগস্টে সমগ্র উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক মাত্রার বন্যার ফলে দেশে বিরাজমান চাল সঙ্কট এ আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেছে ইতোমধ্যে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তর চাল উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম চাল আমদানিকরক দেশে পরিণত হয়েছে।

এ বছর জুন মাসে দেশে চালের মজুদ নেমে আসে এক লাখ ৯১ হাজার টনে যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছর যেখানে মাত্র ৭০ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে সেখানে চলতি বছর সরকার ১৫ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু চাল আমদানির জন্য দেশে দেশে ঘুরেও প্রয়োজনীয় চাল সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তই ভবিষ্যৎ বিপর্যয় এড়াতে এখনই টেকসই উৎপাদনব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করছেন অনেকে।

ভ‚মি জরিপ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। ১৯৮৬ সালে তা দাঁড়ায় ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এবং ২০০৩ সালে আরো কমে দাঁড়ায় মাত্র ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের এক প্রতিবেদনে বল হয়েছে, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ আবাদি জমিতে ধান ও গমের আবাদ হয়।২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে মোট তিন কোটি ৩৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। পাঁচ বছরের মাথায় চালের উৎপাদন সামান্য বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদিত হয় তিন কোটি ৪৫ লাখ টন।

গত পাঁচ বছরে এক লাখ ২৫ হাজার হেক্টর ধান চাষের জমি অন্য খাতে চলে গেছে। অপর দিকে গত ১১ বছরে ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। ফলে প্রযুক্তির সহায়তায় সীমিত জমিতে ধানের উৎপাদন বাড়িয়েও সামগ্রিক উৎপাদন কাঙ্খিত পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না। অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মোট ভ‚মির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষক দল এশিয়ার ধান উৎপাদনকারী ছয়টি দেশের ৩২০টি খামারে গবেষণা চালিয়ে জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গবেষকদের আশঙ্কা, আগামীতে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। তারা জানান, ধানের উৎপাদন বাড়লেও যে হারে জমি কমছে, তাতে একপর্যায়ে উৎপাদন থেমে যাবে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স (পিএনএস)’ সাময়িকীতে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।

এদিকে ফসলের উৎপাদন বাড়ার সাথে জমিতে ব্যাপকহারে সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ এর ফলে মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ টন রাসায়নকি সার ব্যবহার করা হয়।

অপরদিকে জমি কমা সত্তে¡ও ধানের উৎপাদন বাড়লেও হারিয়ে যাচ্ছে অনেক উন্নত জাতের দেশীয় ধান। এ ছাড়া এবার হাওরের পানিতে ধানগাছ তলিয়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ছোট হাইব্রিড ধানগাছকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!