• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কমেছে টাকার কদর


শেখ আবু তালেব, সিনিয়র রিপোর্টার মে ৪, ২০১৭, ০৭:৫৪ পিএম
কমেছে টাকার কদর

ঢাকা: দেশে এখন অলস টাকার পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি। বিনিয়োগে মন্দা ও কম সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের দেশি ব্যাংকে ধর্ণা দিতে হচ্ছে খুবই কম। এতে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার চাহিদা কমেছে। ফলে দেশের কলমানি মার্কেটে সুদহার কমেছে অনেক।

গেল নয় মাস ধরে চার শাতাংশের ঘরেই আটকে আছে সুদের হার। সর্বশেষ গত ঈদেও কলমানি মার্কেটে সুদের হার ছিল গড়ে চার শতাংশের নিচে। অথচ এর আগের বছরে ছিল দ্বিগুণের বেশি। কারণ হিসেবে ব্যাংকগুলো বলছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ টাকা থাকায় কেউ কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিচ্ছেন না।

কলমানি মার্কেটে টাকার সুদ হার কমার পাশাপাশি কমেছে ধার নেয়ার পরিমাণও। সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল কলমানি মার্কেটে সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ৪ টাকা ৫০ পয়সা ও সর্বনিম্ন ২ টাকা। গড়ে এ হার ছিল ৩ টাকা ৮৫ পয়সা। এদিন বাজারে ৬ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা ধার নেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে ৩০.৭ শতাংশ কম টাকা নেয়া হয়েছে কলমানি মার্কেট থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে কলমানি মার্কেট থেকে ৪০.৮ বিলিয়ন টাকা নেয়া হয়েছিল। অপরদিকে ২০১৫ সালে নেয়া হয়েছে ২৮.৩ বিলিয়ন টাকা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে কলমানি মার্কেট থেকে টাকা নেয়া হয়েছিল। সে সময়ে এ হার ছিল সর্বোচ্চ ৯ টাকা ৯০ পয়সা। গড় ছিল  ৮ টাকা ৫৭ পয়সা।

অর্থবিদ্যার মতে, অর্থনীতির গতি বাড়লে ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত তারল্য থাকে না। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে- তা হয়তো বলা যাবে না, তবে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গতি কমেছে অর্থনীতির। তারই প্রমাণ হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ। বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে মূলধনের নয়, অভাব বিনিয়োগকারীর।

দেশের উদ্যোক্তারা এখন বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ নিতে পারছে। ফলে অভ্যন্তণরীণ উৎস থেকে ঋণের চাহিদা আরো কমে গেছে। গত দুই বছর ধরে ক্রমেই কলমানি মার্কেট থেকে টাকা নেয়ার প্রবণতা কমতে থাকে ব্যাংকগুলোর। চাহিদা কমায় সুদের হারও কমতে শুরু করে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুদ হার দাঁড়ায় ৩ টাকা ৬৭ পয়সায়। ২০১৬ সাল জুড়ে গড়ে সুদের হার ছিল ৩ টাকা ৬২ পয়সা।

২০০৩ সালে যেখানে সর্বোচ্চ ৩৩.২৫ টাকা হারে সুদ দিয়ে টাকা নিতে হয়েছিল, সেই হার এখন দাঁড়িয়েছে চার টাকার নিচে। সে সময়ে গড়ে সুদের হার ছিল ৬.৮৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১০ সালে কলমানি মার্কেটে সুদ উঠেছিল ১৯০ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ এক ব্যাংককে ১০০ টাকার বিপরীতে ১৯০ টাকা সুদ দিয়ে নগদ টাকা ধার নিতে হয়েছিল।

এখন টাকা ধার নেয়া লাগছে না কেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে এক ব্যাংকার জানান, সাধারণত নগদ টাকার প্রয়োজনেই ব্যাংকগুলো কলমানি মার্কেট থেকে উচ্চ সুদে অল্প সময়ের জন্য টাকা নিয়ে থাকে। এখন বিনিয়োগের চাহিদা কম। তাই যথেষ্ট টাকা পড়ে আছে ব্যাংকগুলোতে। সেজন্য নগদ টাকার দরকারে ব্যাংকগুলোকে এখন আর কলমানি মার্কেট থেকে টাকা নিতে হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, প্রয়োজন হলেই সরকার ব্যাংকখাত থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু এখন সেই পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে না। সেজন্য ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ যথেষ্ঠ রয়েছে। শুধু ২০১৫-১৬ অর্থ-বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার টার্গেট ছিল ২৮ হাজার ৫২৩ কোট টাকা। সেখানে নিয়েছে মাত্র চার হাজার কোটি টাক। উল্টো সরকার এখন ঋণ পরিশোধ করছে।

বাজারে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এর বিপরীতে কোনো আয় না হলেও ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত সুদ দিতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সুদের হার কিছুটা বেশি থাকলেও ঋণের সহজ প্রাপ্তিতে ভোক্তারা এখান থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। এজন্য কলমানি মার্কেটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকার চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিনিয়োগ নেই, তাই কলমানি মার্কেট থেকে টাকা নিতে হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গৃহায়ন ঋণের চাহিদা ক্রমেই নেতিবাচক ধারায় নামছে। ২০১১ সালে যেখানে মোট ঋণের ১৯.৩ শতাংশ গৃহ ঋণ যেমন বাড়ি, গাড়ি, ফ্লাট ক্রয় করতে নেয়া হত, সেখানে ২০১২ সালে তা কমে ১৭.৬ শতাংশে, ২০১৩ সালে ১২.২ শতাংশে, ২০১৪ সালে ১৭.৫ শতাংশে এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১৭.৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ খাতেও টাকার চাহিদা নেই।

ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের মুনাফায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েকটি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, প্রকৃত পক্ষে তার চেয়ে কম বাস্তবায়ন হচ্ছে।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর বেশিরভাগই সরকারি বিভিন্ন বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করা। ফলে এগুলো থেকে ব্যাংকগুলো নামমাত্র মুনাফা পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অর্থকে অলস অর্থ বলতে নারাজ। তাদের হিসাবে অলস টাকার পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি হতে পারে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আতা

Wordbridge School
Link copied!