• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কর্পোরেট আগ্রাসনে বন্ধ হচ্ছে ছোট ছোট চালের মিল


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুলাই ২৮, ২০১৭, ০৮:১৫ পিএম
কর্পোরেট আগ্রাসনে বন্ধ হচ্ছে ছোট ছোট চালের মিল

ঢাকা: ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বড় মূলধনী কোম্পানি এখন মুনাফার আশায় বিনিয়োগ শুরু করেছে চাল ব্যবসায়। পাশাপাশি রড, সিমেন্ট, তেল উৎপাদনকারীতে শীর্ষে থাকা কোম্পানিও নেমেছে এ খাতে। কর্পোরেট আগ্রাসনে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত কয়েক বছরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ছোট ছোট প্রায় ২৫০টি চালের মিল। যা স্থানীয় বাজারে চাল সরবরাহ করতো।

কর্পোরেট কোম্পানিগুলো চাল ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় বাজারটির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে। দুর্বল হয়ে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ চালের মিল নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দৃষ্টি নন্দন প্যাকেটে মুড়ে বাজারে নিয়ে এসেছে সাধারণ ও সুগন্ধি চাল। ৫, ১০ ও ২০ কেজির ছোট প্যাকেট করেছে। রয়েছে ৫০ কেজি ওজনের বস্তাও। সুগন্ধি চালের প্যাকেট করেছে ১ কেজি করে। প্যাকেট হওয়ায় বিভিন্ন সুপার শপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পাশাপাশি সাধারণ দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে এই চাল। খুচরার চেয়ে প্যাকেট চালে প্রতি কেজিতে দুই টাকা বেশি নিচ্ছে।

দেশের ভোজ্যতেল, চিনি ও আটা ব্যবসার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সিটি গ্রুপ। তাদের রয়েছে মুরগি ও মাছের খামার। সিটি গ্রুপের পাশাপাশি চাল ব্যবসায় নেমেছে, ভোগ্যপণ্য তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান এসিআই, স্কয়ার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, এরিস্টোক্র্যাট এগ্রো, আড়ংসহ বড় বিনিয়োগের কয়েকটি গ্রুপ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রশিদ, মোজাম্মেল, এরফান, সাগর, বিশ্বাস, ফারুক ফ্রেশ, মঞ্জুর, আনোয়ার ব্রান্ড। মিল মালিকদের পাশাপাশি তারাও ৫০ কেজির চালের বস্তা তৈরি করে একটি ব্রান্ড বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন। যতদিন বিনিয়োগ আছে ততোদিন এই ব্রান্ড দিয়ে করছেন ব্যবসা।

খোলা ও প্যাকেটজাত চাল এক হলেও ক্রেতাদের বুঝানো হচ্ছে প্যাকেট চালের গুণগত মান ভালো। দোকানদারদেও বেশি কমিশন দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সঙ্গে থাকছে মাসিক টার্গেট পূরণে বিভিন্ন প্রনোদনা পুরস্কার। দোকানদারদের কথায় আস্বস্ত হয়ে বেশি দামে প্যাকেটজাত চাল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। সিটি গ্রুপের চালের মিলটি নারায়ণগঞ্জে হলেও তাদের অন্যান্য পণ্যর সঙ্গে চালের প্যাকেট চলে যাচ্ছে সুদুর পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত এলাকায়। কর্পোরেট আগ্রাসনে বন্ধ হয়ে পড়ছে ছোট ছোট চালের মিল।

চাল উৎপাদনের জেলা বলে খ্যাত নওগাঁ, বগুড়া ও আশপাশের জেলা সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে প্রায় ২৫০টি মিল উৎপাদন বন্ধ করেছে। বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটাতে হয়েছে তাদের। অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হয়েছে। বন্ধ হওয়া মিলের যন্ত্রপাতিও বিক্রি করতে পারছেন না। এই মিলের সঙ্গে জড়িত লিংকেজ প্রতিষ্ঠান(কারিগর, মেশিনারিজ সরবরাহকারি, খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী) গুলোরও ব্যবসা কমেছে। শ্রমিকদের অন্য পেশায় নামতে হয়েছে। অনেক শ্রমিককে কাজের সন্ধানে ঢাকা বা চট্টগ্রামে যেতে হয়েছে।

চালের মিল শ্রমিক এখন তিলখাজার হকার

নীলফামারি জেলার জলঢাকা উপজেলা সদরের চাল মিলের শ্রমিক ছিলেন ভেলু মিয়া। তিনি জানান, আগে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ মণ ধান সিদ্ধ করতাম। চাল তৈরির পরে তা বাজারে চলে যেতো। আয় যাই হোক এলাকায় ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী নিয়ে থাকতে পারতাম। এখন মিল বন্ধ, আয় নেই। বছরের অধিকাংশ সময় ঢাকায় থাকি। ফেরি করে তিল খাজা বিক্রি করি। দুই তিন মাস পর পর বাড়ি যাই।
আক্ষেপ করে বলেন, এলাকায় অনেক মানুষের টাকা হচ্ছে। যে জমি কেউ কিনতো না, সেই জমির দাম এখন শতক প্রতি আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু কাজ নেই। গরিবের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, বড় কোম্পানি বেশি বিনিয়োগ করে বাজারে আসছে। তাদেও পণ্যেও বিজ্ঞাপন আছে। ছোট ছোট মিলের পক্ষে বিজ্ঞাপন দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।

চিনির পরে কর্পোরেট সিন্ডিকেটের হাতে চালের বাজার

বর্তমানে ভোগ্যপণ্যর মধ্যে চিনি, তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যর মূল্য নির্ধারণ করে দেয় কর্পোরেট সিন্ডিকেট। সরকারও এই সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়। তেল, চিনি ও রমজানে ছোলার দাম গত কয়েক বছরে একবারও সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। সর্বশেষ গত রমজান মাসেও উচ্চ মূল্যে চিনি কিনতে হয়েছে দেশবাসিকে। অনেক পরে সরকার বিশেষ অভিযান চালিয়ে দাম কমাতে পেরেছিল। কিন্তু ততোদিনে সিন্ডিকেটটি তাদের টার্গেট অনুযায়ী উচ্চ মুনাফা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে।
চালের বাজার যদি তাদের দখলে চলে যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে সাধারণ মানুষ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবাইকে সম্পৃক্ত রাখা। ছোট মূলধনী প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দিতে নীতিমালা দিয়ে সহযোগিতা করা। কোনো পণ্যর বাজার একক বা যৌথ সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। এতে ম্যানিপুলেট(কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে স্বার্থ হাসিল) করে পণ্যর দাম বাড়িয়ে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। সরকারও বিপদে পড়ে। তাদের মতে, পণ্যর বাজারে কাউকে ব্যবসা করতে মানা করা যাবে না। আবার সব ব্যবসায়ী সব পণ্য উৎপাদন করবে এটাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের উচিত হবে বড় বড় গ্রুপকে বিনিয়োগ করার জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা। পুরনোতে নয়, তাহলে সবাই লাভবান হবে।

ছোট ছোট মিল চালু থাকলে, এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি এলাকায় উৎপাদিত চাল সেই এলাকায় কিছুটা কম মূল্যে পাওয়া যাবে। তাদের পরিবহন খরচ না থাকায় দেশের জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। গত অর্থবছরে সরকারিভাবে ৩.৯৩ লাখ মেট্রক টন ও বেসরকারিভাবে ৫০.০৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার মে মাস পর্যন্ত ১.১৫ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। গত কয়েক বছর দেশে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়নি। চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। হাওরের বন্যায় প্রায় ৯ লাখ টন চাল নষ্ট হওয়ার পরেও দাম বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে এই দাম।

এর কারণ হিসেবে অনেকগুলোর মধ্যে কর্পোরেট আগ্রাসনও একটি কারণ। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক সুবিধা বড় মূলধনী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট ছোট শিল্পের নিরাপত্তা দিতে হবে। এই ছোট শিল্পই গ্রামীণ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেএ

Wordbridge School
Link copied!