• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ২৪, ২০১৬, ০১:৪৯ পিএম
কর্মক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক

কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের যেমন রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তেমনই রয়েছে প্রাণহানির ঝুঁকিও। গত ৮ বছরে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ৮শ জন শ্রমিক। আহত এবং অসুস্থ হয়েছে তার তিনগুণেরও বেশি। আহত এবং রোগাক্রান্ত অনেক শ্রমিক চিকিৎসার অভাবে দিনের পর দিন ধুঁকে ধুঁকে মরছে।

দেশের শিল্প খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরূপণে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি পেশা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা বৃত্তান্তের (অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি প্রোফাইল) খসড়ায় উঠে এসেছে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের দুরারোগ্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার চিত্র এবং গবেষণা ও শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে কর্মস্থলে শ্রমিক নিহত হবার পরিসংখ্যান।

অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি প্রোফাইল’র তথ্যমতে, দেশের সব খাতেই কমবেশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতগুলো হলো নির্মাণ, চামড়া, চিংড়ি, রি-রোলিং, পাট, ক্ষুদ্র রসায়ন, জাহাজ ভাঙা ও তৈরি পোশাক শিল্প। এই ৮খাতে কাজ করছে প্রায় ৫০লাখ শ্রমিক। 

আর বিলস’র তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করতে গিয়ে শুধু গত বছরেই (২০১৫ সালে) মারা গেছে ৩৬৩ শ্রমিক। বিলস’র প্রতিবেদনে অনুযায়ী, সচেতনতা ও কর্মস্থলের নিরাপত্তাহীনতার কারণে ২০১৫ সালে কাজ করতে গিয়ে সারা দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬৩ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা গেছে পরিবহন খাতে ১২৫ জন।

এ ছাড়া কর্মস্থলে গত বছর আহত হয়েছে ৩৮২ জন। বিলসের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, মারা যাওয়া শ্রমিকের মধ্যে পুরুষ শ্রমিক রয়েছে ৩২৬ এবং নারী ৩৭ জন। আগের কয়েক বছরে দেখা গেছে, কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হয় প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে।

২০১২ সালে তাজরীন অগ্নিকান্ডে ১১২ জন এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে গার্মেন্ট খাতে তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ কারণে এ খাতে কর্মস্থলে শ্রমিক নিহতের সংখ্যা কমে আসে। তবে গত বছর তৈরি পোশাক খাতে বিভিন্ন কারণে কর্মস্থলে মৃত্যু ঘটেছে ২১ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন ১৫ জন এবং নারী ছয়জন। এ ছাড়া গত বছর গার্মেন্ট খাতে আহত হয় ১১০ জন শ্রমিক।

বিলসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পরিবহন ও গার্মেন্ট খাত ছাড়াও নির্মাণ খাতে কর্মরত শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা অনেক। গত বছর নির্মাণ খাতে কর্মরত শ্রমিক নিহত হয়েছে ৬১ জন। এর মধ্যে সকলেই পুরুষ শ্রমিক। এ ছাড়া নির্মাণ খাতে আহত শ্রমিকের সংখ্যা ১১৯ জন।

অন্যান্য কারখানায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩৭ জন, দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা ২৮ জন, কর্মস্থলে কৃষক মারা গেছে ৯ জন, ইলেকট্রিসিটিতে ৯ জন, ইটভাটায় সাতজন, বিদেশি শ্রমিক পাঁচজন, পাহাড় কাটা শ্রমিক তিনজন, রাইস মিল শ্রমিক দুজন, রেলওয়ে শ্রমিক একজন।

এ ছাড়া খাত সুনির্দিষ্ট নয় এমন কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মারা গেছে আটজন এবং অন্যান্য খাতে কর্মরত শ্রমিক মারা গেছে ৪৭ জন। বিলসের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, ২০০৮ সালে ৫৪৭ জন, ২০০৯ সালে ৩৭৮ জন, ২০১০ সালে ৭০৩ জন, ২০১১ সালে ৮৭৯ জন, ২০১২ সালে ৯০৬ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭০৬, ২০১৪ সালে ৬০৩ এবং ২০১৫ সালে ৩৬৩ জন নিহত হন। এদিকে মৃত্যু ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নানান অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন শ্রমিকরা।

সূত্র জানায়, ধূলিকণার কারণে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন জাহাজ ভাঙা ও রসায়ন শিল্পের শ্রমিকরা। জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন মেসোথেলিওমা (ক্যান্সার) ও এসবেসটোসিস বা শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যায়। ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিজ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনে ভোগেন চামড়া ও রি-রোলিং মিলের শ্রমিকরা।

নিরাপদ স্যানিটারি ব্যবস্থার অভাবে নানা ধরনের স্ত্রীরোগজনিত সমস্যায় ভুগতে হয় নির্মাণ খাতের নারী শ্রমিকদের। আর আর্দ্র পরিবেশে কাজ করার কারণে দীর্ঘমেয়াদি ঠান্ডাজনিত রোগে ভোগেন চিংড়ি শিল্পের শ্রমিকরা। বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাট শিল্পে কাজ করেন দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক।

শ্রমিকদের মধ্যে শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এসব রোগের উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার ঝুঁকি বহন করেন এ খাতের শ্রমিকরা। বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভের তথ্য অনুযায়ী মৌলিক আয়রন এবং স্টিল বা রি-রোলিং খাতে কাজ করেন লক্ষাধিক শ্রমিক। এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমার মতো রোগ।

চামড়া পুড়ে যাওয়া, ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিজ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনও বেশি দেখা যায় এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যে। তথ্যমতে, মৌলিক রসায়ন শিল্পে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক। এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যেও উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমার ঝুঁকি রয়েছে।

অতিমাত্রায় ধূলা অ্যালার্জি ও ব্রঙ্কাইটিস ঝুঁকিতে ফেলছে রসায়ন শিল্পের শ্রমিকদের। কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালা-২০১৩’তে বলা হয়েছে, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বিভিন্ন কনভেনশন/ঘোষণা/রিকমেন্ডেশন/দলিলের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

নিরাপদ কর্মস্থল ও পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে এরই মধ্যে জাতীয়ভাবে প্রণীত বিভিন্ন আইন ও বিধি-বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তার প্রয়োগ নামেমাত্র।

কর্মস্থলে শ্রমিক মৃত্যুর প্রধান কারণ নিরাপত্তাহীনতা হলেও অনেক খাত রয়েছে যেখানে শ্রমিকদের কাজের উপযোগী যথাযথ পরিবেশ নেই। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জোর করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এসব কারণে দিনকে দিন কর্মস্থলে শ্রমিক মৃত্যুর হার বাড়ছে। তাছাড়া কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলেও তার পরিবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায় না।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!