• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
সুজন তাজওয়ার-এর মে দিবসের অণুগল্প

কার কাছে যাব?


সাহিত্য-সংস্কৃতি ডেস্ক মে ১, ২০১৭, ০৯:১৫ পিএম
কার কাছে যাব?

রজিম মামা

এ জি বি কলোনি। একটি কদম গাছ। তাতে পুষ্প পসরার পূর্ব প্রস্তুতি। সামনেই তো বর্ষা। আমি দাঁড়িয়েছিলাম কদম তলায়। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন কাটলো। হঠাৎ চোখে গেল উপরের দিকে। গাছের প্রতিটি শাখায় কদমের সবুজ পুষ্প গুটোরি। এগুলোই তো একদিন কারুকাজ মণ্ডিত শুভ্র কদমফুলে রূপান্তরিত হবে।

এসব কিছু যখন ভাবছিলাম, হঠাৎ করেই সামনের রাস্তা দিয়ে এক সুন্দরীর আগমন। কী বর্ণনা দেব তার? যেন সাদা অ্যাপ্রোনে বর্ষার আগাম কদমফুল হয়ে সামনে এলো। কি আশ্চর্য! একবারও ফিরে চাইলো না আমার দিকে। তার দৃষ্টি মহাকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ধরিত্রী তার কাছে যেন কিছুই না?

এক পর্যায়ে কলোনি থেকে প্রস্থান করলাম। আরামবাগে টিউশনি আছে। দ্রুত ছুটলাম সেদিকে। বাসার সামনে আসতেই চোখ পড়লো গেইটে তালা। কিন্তু একি! কেচিগেইটের এপারেই যে সেই মেয়েটি। অপেক্ষা করছে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। কি আর করা? কাঁচুমাচু হয়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়ালাম। আমারও পথ যে একটাই, গেইট অতিক্রম।

এবার অবগুণ্ঠন খুললো সেই সুন্দরী। না না, যা ভাবছেন না তা নয়। আগ বাড়িয়ে বললেন, গেইটেই চাবি আছে আপনার কাছে? সুন্দরীর দিকে বোকার মতো অপলক তাকিয়ে রইলাম। চাপা স্বরে শুধু উত্তর করলাম, না।

খানিক পরেই গেইটের দারোয়ান রমিজ মামা হাজির। হন্তদন্ত হয়ে তালা খুলতেই সুন্দরীর কণ্ঠ চড়াও হলো। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রমিজ মামার ওপর- ‘জানোয়ারের বাচ্চা.......’

আমার ভাবনার কদমফুল মুহূর্তেই পরিণত হলো ধুতরা ফুলে। ঝুলিতে থাকা আরো কয়েকটা আদিগালি বর্ষালেন মামার ওপর। এরপর সিঁড়ি দিয়ে খট খট আওয়াজ ছড়িয়ে ধুতরাফুলটি দ্রুত উঠে গেলেন উপরের দিকে।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম রমিজ মামার পাশে। মামাকে প্রশ্ন করলাম, মেয়েটি কে? আঁখি ছলছল বেদনায় কাতর কণ্ঠে মামার উত্তর, মালিকের নাতনি। মামার কাঁধে হাত রেখে বললাম, কিছু মনে করবেন না মামা। চলেন আপনার রুমে গিয়ে বসি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে মামা তার রুমে নিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকেই উৎকট অপরিচিত পরিবেশ চোখে পড়লো। এই ঝলমলে শহরে যা একেবারেই বেমানান। তার থাকা, শোয়া ও খাবার জায়গার বর্ণনা নাই বা দিলাম। মেয়ের বয়সী একজনের তীব্র গালি হজম করছিলেন আর নীবরে চোখ মুছছিলেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দিই। মামা বলতে থাকেন,

-আজ ছয় মাস ধরে বাড়ি যাই না। ছোট মেয়েটা খুব অসুস্থ। বউ ফোন করে কইল, আজ নাকি শ্রমিক দিবস। তাই দুই দিনের ছুটি চাইতে উপরে গেছিলাম বড় সাহেবের কাছে। সেও আমাকে অনেক গালমন্দ করেছে। নিচে তার নাতনীও।

পরে রজিম মামা কান্না থামিয়ে আমার চোখের দিকে তাকান। বলেন, 

- মামা একটা কথার উত্তর দিবেন? 

- কি?

- দারোয়ানরা কি শ্রমিক না? 

- কেন নয়?

- তাহলে আজ কেন আমাকে ছুটি দিল না মামা? আমরা গরীব বলে কি আমাদের কোনো শখ-আহ্লাদ নেই। আমাদের কি সংসারের খোঁজ-খবর নেয়া পাপ? বউ-বাচ্চাদের প্রতি কি আমাদের দরদ নেই?

চুপ হয়ে রজিম মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। নিজেকে রমিজ মামার কাতারে ফেলি। ভাবি, আমিও কোচিং এ পড়াই। তারাও আজ আমাকে কোনো ছুটি দেয় নি। আমিও তো অনেক দিন বাড়ি যাই না। মা-বাবার মুখ দেখি না কতদিন।

মনটা কেমন বর্ষাকালের আকাশের মতো হয়ে গেল। আজ আর পড়াতে গেলাম না। রমিজ মামার হাতটি শক্ত করে ধরে বললাম,

- মামা, যাবেন আমার সঙ্গে? একটা সুরাহা করতে?

মামা নির্বিকার ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 

- কোথায় যাব? কার কাছে যাব?

রজিম মামার চোখে মুখে রাশি রাশি শূন্যতা।

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!