• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগারে কেমন ছিলাম?


ফেসবুক থেকে ডেস্ক  আগস্ট ১৯, ২০১৭, ০৮:৪৯ পিএম
কারাগারে কেমন ছিলাম?

ঢাকা: ২০১৫ সালে সিনিয়র সাংবাদিক ও দৈনিক যুগান্তরের বিজনেস এডিটর হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান। ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেন হেলাল উদ্দিন। চলতি বছরের ২২ জুলাই বিচারক আদালতে হাজির হয়ে তিনি স্থায়ী জামিন প্রার্থনা করেন। কিন্তু আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তিনি মুক্তি পাওয়ার পর অনেক শুভাকাঙ্খী জানতে চান- ‘জেলখানা কেমন? সেখানে তিনি ভালো ছিলেন কি না? কোনো অসম্মান হয়েছে কি না? 

এসব প্রশ্নের জবাব দিতে শনিবার (১৯ আগস্ট) ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সিনিয়র সাংবাদিক Helal Uddin । সোনালীনিউজের পাঠকদের জন্য তার সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো- 

‘অনেকেরই প্রশ্ন। জেলখানা কেমন? ভাল ছিলাম কি না। কোন অসম্মান বা হয়রানি হননি তো? হঠাত কেন কেরানীগঞ্জ থেকে কাশিমপুরে পাঠালো? শেষ প্রশ্নের জবাব, অবৈধ অর্থ আর প্রভাবে আমার শত্রুরা অনেক বেশী শক্তিশালী। আমি নাকি কারাগারে ভিআইপি সম্মান পাচ্ছি। বাইরের খাবার খাচ্ছি। প্রতিদিনই সাংবাদিক/দর্শনাথী আসছে।

রাজনৈতিক নেতাদের সংগে নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছি-এমন সব কথিত অভিযোগেই নাকি উচ্চ পর্যায়ের (?)সিদ্ধান্তে আমাকে পাঠানো হয় অনেক দুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। যেখানে দেশের সব দুর্ধর্ষ আসামী, জংগী, শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৫ শতাধিক ফাসির দণ্ডপ্রাপ্তদের বসবাস। এ কথা প্রচলিত শাস্তিমূলকভাবেই বন্দীদের পাঠানো হয় হাইসিকিউরিটিতে।

কিন্তু বিধিবাম। আমার জন্যে এ শাস্তি হয়েছে সোনায় সোহাগা। জেল কর্তৃপক্ষের বদান্নতায় কেরানীগঞ্জের চেয়ে কাশিমপুরেই আমি বেশি আরামে ছিলাম। এখানে খাদ্যমান উন্নত। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার বিশাল এলাকা নিয়ে। সে তুলনায় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি অতি ক্ষুদ্র। প্রায় ১৯৫ একর জমির উপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আধুনিক স্থাপত্যশৈলির সুরম্য ভবন। চারদিকে খোলামেলা, আলো-বাতাস ভরপুর।

তবে পর্যাপ্ত গাছ না থাকায় দুপরে মরুভূমির মত তপ্ত হাওয়া। একরের পর একর খোলা জমি পড়ে আছে যেখানে নিয়মিত সবজি চাষ করা যায়, ফলফলাদির গাছ লাগানো যায়। ভবনগুলোর নির্মান মান অতি নিম্ন। এখনই আস্তর খুলে পড়ছে। তবে সর্বত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ছোয়া। বড় মাঠে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা হয়। গান হয়। বন্দীদের পাশাপাশি জেলার, ডেপুটি জেলাররা প্রায়ই একসংগে খেলেন। বিকেলে হাজার হাজার বন্দীর কলকাকলীতে পুরো জেলখানাই প্রানবন্ত হয়ে উঠে। 

কাশিপুরে ৪টি কারা কমপ্লেক্সে মোট জমি ১১০ একর। এরমধ্যে হাইসিকিউরিটির জমি মাত্র সোয়া ৯ একর তবে সবুজে ভরপুর। দুর্নীতিমুক্ত, সেবা, পরিচ্ছন্নতায় এই ক্ষুদ্র কারাগারটি দেশের মডেল হতে পারে। এমন কোন খালি জমি দেখিনি যেখানে তরকারি চাষ হচ্ছে না। আর আছে পরিকল্পিত ফলের বাগান। সর্বত্রই গাছপালা ভরপুর আর প্রকৃতির ছোয়া। পরিচ্ছন্নতা লক্ষ্যনীয়। নিয়মিত খাবার মান উন্নত।

৩/৪ পদের নীচে তরকারি রান্না হয় না। পিসির খাদ্যমান খুবই ভাল। অত্যন্ত রুচিকর। যেখানে কেরানীগঞ্জে খাবার মান খুবই নিম্নমানের। বিশেষ করে পিসির খাবার খুবই অরুচিকর। তেলে ভরপুর। রান্নার চেহারা দেখলেই খারাপ লাগে। দাম অনেক বেশি। সেখানে কাশিমপুরের রান্না সুস্বাদু, মান সম্মত।

কেরানীগঞ্জ এবং কাশিমপুর জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে সর্বোচ্চ সেবাযত্ন করেছে, সম্মান দিয়েছে। যেকোন কারণেই হোক। হয়তো একজন সিনিয়র সাংবাদিককে যথাযথ মর্যাদা দেয়া তাদের নৈতিক কর্তব্য মনে করেছেন।। হয়তো জেলগুলোতে সরবরাহকৃত সংবাদপত্রের ৮৫ শতাংশের বেশি দৈনিক যুগান্তর। আর সেই জনপ্রিয় পত্রিকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক কষ্ট পাবেন তা কি হয়?

দুটি কারাগারে আমার সেবাযত্নে পৃথক সেব ছিল। পুরো জেলাখানাই ছিল আমার জন্যে উন্মুক্ত। সকাল-বিকাল নিয়মিত হাটার সুযোগ ছিল। তবে সব কিছুই করা হয়েছে কারাবিধি মেনে। আগে কারাগার নিয়ে ভীতি ছিল। কিন্তু এখন সব বন্দীদের সংগেই মানবিক আচরণ করা হয়। শাস্তি নয়, সংশোধনই যেন সবার লক্ষ্য। এ জন্যে সুযোগ সুবিধা অনেক বেড়েছে।

প্রথমদিন কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে যে বিরল সম্মান আর সুযোগ সুবিধা পেলাম তা ছিল অপ্রত্যাশিত। কারা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতায় মনে হয় ক'দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছি মাত্র। কারারক্ষী / কারাবন্দীদের ব্যবহার ছিল প্রাণবন্ত। সবাই যেন সহায়তা করতে এক পায়ে খাড়া। মুগ্ধ হয়েছি বারবার।। বিশেষ করে সাজাপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্যদের আন্তরিকতা ছিল চোখে পড়ার মত।

মূলত তারাই কারাগারগুলোতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এ জন্যে তাদের কতৃর্ত্ব বেশি। বিভিন্ন ধরনের সাজাপ্রাপ্ত আসামী, কয়েদী বা হাজতীরা সাংবাদিক পরিচয় জেনে শুধু তাদের সমস্যা জানাতে চায়। জেলখানার ভাল মন্দ মুখ ফুটে বলতে চায়। অনেকের বিনাদোষে কারাজীবন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তা জানাতে চায়। জামিনের নামে আইনজীবীরা প্রতারিত করছেন এমন অভিযোগ অহরহ।

আমি কেরানীগঞ্জে যে কক্ষে ছিলাম তা সর্বোচ্চ তলায়। প্রায় ৩৫ ফুট দীর্ঘ, ২৫ ফুট প্রশস্ত কক্ষ। বসবাস মাত্র ১৩/১৪ জনের। এটা মেডিক্যাল। আমি ছিলাম অসুস্থ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিকসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। কক্ষে হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন বেড, ছোট সাইডটেবিল, ফ্যান, উভেন আর ছোট টিভি আগে থেকেই ছিল। অবশ্য সব কক্ষে এসব নেই। কক্ষের শেষ প্রান্তে দেয়াল ঘেরা দুটি টয়লেট, ৩টি বেসিন আর দুটি প্রশস্ত গোসলের স্থান। রুমের দু'জন সেবক সব সময়ই আমার সেবাযত্নে ব্যস্ত ছিল। 

সুখকর বিষয় ছিল : 

কেরানীগঞ্জ কারাগারে মেডিকেলের সর্বোচ্চ তলায় সুপরিসর কক্ষ। বাইরের মনোরম প্রানজুড়ানো দিগন্ত ছোয়া দৃশ্য। বিশেষ করে ঢাকা মাওয়া মহসড়কের দিনরাত ব্যস্ততা চোখে পড়তো। ঘরথেকেই বিস্তীর্ণ সবুজ দেখলে সত্যি মন ভাল হয়ে যায়। পুরো কারাগারটির সেৌন্দর্য অপরিসীম। মনে হয়েছে, কারা কর্তৃপক্ষ শাস্তির চেয়ে অপরাধ সংশোধনেই মনোযোগী বেশি।

তবে কাশিমপুর কারাগারের দৃশ্য এবং পরিবেশ আরও চমতকার। গাজী নামের দক্ষিণমুখী বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় একটি কক্ষে আমাকে রাখা হয়। নিরাপত্তার জন্যে বা কেউ যাতে বিরক্ত না করে এ জন্যে পুরো করিডোরই প্রায় খালী।

আগে যেখানে ২০/২৫জন বন্দী ছিল সেখানে শুধু আমি, সেবক আর একজন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। কয়েকটি রুমের লক নষ্ট থাকায় আগে থেকেই তা বন্দিশুন্য ছিল। ভবনের দক্ষিন-পূর্ব কর্ণারে আমার কক্ষের সামনে সাড়ে ৪ ফুট চওড়া প্রশস্ত বারান্দা। বিকেলে বারান্দায় বসলে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যি মুগ্ধকর। সব সময় দখিনের মনোরম বাতাস আর খোলা প্রান্তর দেখে মন ভরে যায়।

তবে এ কথা সত্যি জেল জীবন আর মুক্ত জীবনের পার্থক্য আকাশ পাতাল। এ অভিজ্ঞতা ছাড়া জীবনে পূর্ণতা আসবে না। আর আমি? আগে অনেক ভীতি ছিল। বিশেষ করে কাশিমপুরের বসবাস অভিজ্ঞতা এতই চমতকার যে. মনে হচ্ছে, আহ্-আবার কবে যাব?

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেএ

Wordbridge School
Link copied!