• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুমার নদের পরিণতি কি বুড়িগঙ্গার মত হবে?


ফরিদপুর প্রতিনিধি এপ্রিল ২৩, ২০১৭, ০৩:২৫ পিএম
কুমার নদের পরিণতি কি বুড়িগঙ্গার মত হবে?

ফরিদপুর: জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র কুমার নদটি দিন দিন ভয়ংকরভাবে দূষিত হয়ে পড়ায় জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জীবাণু ও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।

প্রায় ৭৩ কিলোমিটার বিস্তৃত কুমার নদ ফরিদপুর অম্বিকাপুর হতে বাখুন্ডা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে শহরের মধ্য দিয়ে। ফরিদপুর শহরের পানির সবচেয়ে বড় উৎস এই নদ। কুমার নদের দুই পাশে অবস্থিত তিতুমীর বাজার ও  হাজী শরীয়তুল্লা বাজার এলাকার আশেপাশে এ নদীর দুষণ চরম আকার ধারণ করেছে।

তিতুমীর বাজার সংলগ্ন শিব মন্দির এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে বাজারের সব ময়লা কুমার নদ ও নদ সংলগ্ন পাড়ে ফেলা হচ্ছে। শিব মন্দিরের উত্তর পাশে পৌরসভার ড্রেন দিয়ে পয়ঃ বর্জ্য এসে পড়ছে নদে। শিব মন্দিরের দক্ষিণ পাশে বাধানো ঘাটলার পাশে বাজারের যাবতীয় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। শরিয়তুল্লাহ বাজারের মাছ বাজার, মুরগি বাজার ও কসাই পট্টি যাবতীয় পয়ঃ বর্জ্য ও আবর্জনা প্রতিদিন অবাধে ফেলা হচ্ছে নদে। আলিমুজ্জামান বেইলি ব্রিজের নিচে গড়ে উঠেছে ময়লার ভাগাঢ়। দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টসাধ্য। কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাও দুষ্কর। এর মধ্যেই মানুষ গোসল করছে।

প্রতিদিন শহরের অসংখ্য মানুষ এ নদে গোসল করে। দূষিত পানিতে গোসল করে গায়ে চুলকানি হয়েছে অনেকের। মাছ চাষ এবং কৃষি জমিতে সেচ দেয়ার জন্যও এ নদের গুরুত্ব অপরিসীম। মাঝে মধ্যে নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। নদী এবং নদীর পাড়ে ময়লা-আবর্জনা পয়ঃ বর্জ্য ফেলায় শহরবাসী সমস্যায় পড়ছে। এ ব্যাপারে পৌরসভা ও ব্যবসায়ীদের সাথে দেন দরবার করেও কোনো ফল হয়নি।

২০১৪ সালের এপ্রিলে ফরিদপুর পৌরসভা ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে ২৫ হাজার হাউস হোল্ডারের মধ্যে থেকে ৮০০ হাউস হোল্ডারের সেফটিক ট্যাংকের উপর জরিপ করে। ওই জরিপ থেকে দেখা যায় বাসাবাড়ির ৪৫ ভাগ পরিবার কখনই সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করেনি। এর মধ্যে ৫৬ ভাগ পরিবারের স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দেয়া রয়েছে। ওই সময় অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জরিপ করে দেখা গেছে ১৯ ভাগ প্রতিষ্ঠান কখনই সেফটি ট্যাংক পরিষ্কার করেনি। এই ১৯ ভাগ প্রতিষ্ঠানের সেফটি ট্যাংকের সংযোগ সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন বাসাবাড়ির সেফটি ট্যাংকির সাথে পৌরসভার পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের অবৈধ সংযোগ রয়েছে। ডিজাইন মানদণ্ড হিসেবে যে কোন সেফটিক ট্যাংক ও পিটের (রিং দিয়ে কুয়ার মত বানানো) পানি কখনও ভূ-উপরিতলের পানির সাথে মিশতে পারবে না বলে বিধান রয়েছে। ওই পানি শুধুমাত্র ফিলটারেশন হওয়ার পর মিশতে পারে। কিন্তু ফরিদপুর পৌরসভার নর্দমা দিয়ে সেফটি ট্যাংকের পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে কুমার নদে।

১৯৯৭ সালের এনভায়রনমেন্ট কনজারভেশন রুল অনুযায়ী স্যুয়ারেজের পানির কোয়ালিটি নির্ধারণ করা হয় বিওডি (বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড, জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা) ও ফোকাল পলির্ফর্ম (পয়ঃ বর্জ্য থেকে যে জীবাণু উৎপন্ন হয়) মাত্রার ভিত্তিতে।

ফরিদপুর পৌরসভার বড় তিনটি নর্দমার মুখ থেকে পানি সংগ্রহ করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর কৌশল বিভাগে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ওই পানিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় বিওডি ( জৈব দূষণ) ও ফোকাল পলির্ফর্ম  (অজৈব দূষণ) রয়েছে। পানিতে বিওডি বা জৈব দূষণ বেশি থাকার অর্থ হলো অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া। এর ফলে এই পানিতে মাছ ও শৈবাল জাতীয় জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ হ্রাস পায় এবং পানি শুদ্ধকরণের জন্য ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না। ফলে পানির স্বাভাবিক বিশুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। পানির জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাতে পারে। বিওডি প্রতি লিটার পানিতে ৪০ মি. গ্রাম থাকলে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেখানে ওই পানিতে রয়েছে ৩৮০ মি. গ্রাম যা স্বাভাবিকের চাইতে সাড়ে নয় গুণ বেশি।

অপরদিকে ফোকাল পলিফর্র্ম বা অজৈব দূষণ ১০০মিলি লিটার পানিতে ১০০০ মাত্রাকে সহনশীল ধরা হয়। সেখানে ওই পানিতে রয়েছে ২৫৪০ অর্থাৎ আড়াই গুণেরও বেশি। অপরদিকে  ফোকাল পলিফর্র্ম  মূলত মলবাহী জীবানুর জন্ম দেয়। এর ফলে পানি ব্যবহারের উপযোগী তো থাকরেই না উপরন্তু ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানাবিধ জটিল রোগের সৃষ্টি করে।

ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. অরুণ কান্তি বিশ্বাস বলেন, নদীর পানিতে  বিওডি, ফোকাল পলিফর্র্ম  মাত্রা বেশি হওয়ায় কুমার নদের পানি দূষিত হয়ে গেছে। নদর্মার পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এটি কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করাসহ নদীর স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত রাখতে হবে।

ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ, পৌরসভার নর্দমা সংযোগ সরাসরি নদীর সাথে হতে পারে না। নর্দমার পানি শোধন করে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু তা না করে পৌরসভা সরাসরি নর্দমার পানি নদীতে ফেলছে।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহাতাব আলী মেথু বলেন, আমরা উপায়হীন হয়ে নর্দমার পানি নদীতে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। তবে আমাদের পরিকল্পনা আছে নর্দমার মুখে আলাদা রিজারভার নির্মাণ করে পানি রিফাইন করার। তিনি বলেন, পয়ঃবর্জ্যের সমস্যা স্থায়ী সমাধানের জন্য ফরিদপুর পৌরসভা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রাকটিক্যাল এ্যাকশনের যৌথ উদ্যোগে বিল এন্ড মেরিন্ডা গেট ফাউন্ডেশন ও ইউকে এইড এর অর্থিক সহায়তায় ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর সানট্রেবল স্লাজ ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস ইন ফরিদপুর, বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় বৈজ্ঞানিকভাবে পয়ঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, যে সব গ্রাহক স্যুয়ারেজের সংযোগ সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুমার নদের পানি ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ জানান, দিনদিন যেভাবে দূষিত হচ্ছে কুমার নদের পানি, তাতে ঢাকার বুড়িগঙ্গার মত কুমার নদের পরিণতি হতে খুব বেশি দেরী নেই। দূষণের হাত হতে ফরিদপুরের কুমার নদকে বাচানো একান্ত জরুরি।

ফরিদপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আহমেদ বলেন, নাগরিক বা পৌরসভার কোন স্যুয়ারেজ বা নর্দমার সংযোগ সরাসরি কোন নদী, বা খাল বা উন্মুক্ত জলাশয়ে যুক্ত করার নিয়ম নেই। যত দ্রুত সম্ভব  পৌরসভা ও পৌরবাসীকে এ সংযোগগুলি অপসারণ করে নিতে হবে। পরিবেশ দুষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য কোন হুমকি আমরা মেনে নিতে পারি না।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!