• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
এমপি লিটন হত্যা

কে এই ক্ষমতালোভী কাদের খান


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭, ০৪:০৯ পিএম
কে এই ক্ষমতালোভী কাদের খান

ঢাকা: আবদুল কাদের খান। একাধারে তিনি একজন চিকিৎসক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। রাজনীতিতে তেমন একটা পরিচিত এবং আলোচিতও নন। এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৮ সালে।

রাজনৈতিক মাঠে অত্যন্ত স্থির ও ধীর মানসিকতার এই মানুষটিই এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত নাম। পুলিশ বলেছে সাবেক এই এমপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছেন সুন্দরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন।

এমপি লিটন হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক এমপি আবদুল কাদের খানের নাম আসায় বিস্মিত সবাই। দীর্ঘ তদন্তের পর সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কাদের খানকে তথ্যপ্রমাণসহ গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু ধীর মানসিকতা-সম্পন্ন কাদের খান এমন কিছু ঘটাতে পারেন, এমনটা ভাবতেই পারেননি নিহত এমপির পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠজন ও দলের নেতাকর্মীরা।

লিটন হত্যায় যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল সেসব অস্ত্রও কাদের খানের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কিলিং মিশনে অংশ নেয়া কাদের খানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর চার কিলার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কাদের খানই যে মূল পরিকল্পনাকারী, কিলারদের জবানবন্দিতে তা উঠে এসেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

এ হত্যাকাণ্ডের পর সবার সন্দেহ ছিল জামায়াত-শিবির কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠীর দিকে। সন্দেহভাজন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের ১১০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এমনকি এমপি লিটনের পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ঘটনার ১ মাস ২০ দিনের মাথায় তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে গত ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন সাবেক সংসদ সদস্য ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ডা. আবদুল কাদের খান। তাকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত নিহত এমপি লিটনের সঙ্গে তার বৈরী সম্পর্ক ছিল, এমন কথা কেউ বলেননি। কিংবা এমপি লিটন ও কাদের খানের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল এমন কোনো ধারণাও পাওয়া যায়নি।

তবে কাদের খান গ্রেপ্তারের পর লিটনের একসময়ের একান্ত সহকারী ও সুন্দরগঞ্জের ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (সুজা) গণমাধ্যমকে জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভাই (লিটন) কাদের সাহেবকে হেল্প করেছিলেন। তার মিটিং-মিছিল করে দিয়েছিলেন। এর জন্য নেতাকর্মীদের টাকাও দিয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কাদের খান আর মনজুরুল ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী। তখনো তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে কোনো ঝামেলা হয়নি।

জামায়াত-শিবির ৩৫-৪০টি কেন্দ্রে ভাঙচুর করায় নির্বাচনের ফলাফল পিছিয়েছিল। সুজা আরো বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জেলা পরিষদের এক কোটি টাকার একটা বরাদ্দ নিয়ে লিটনের সঙ্গে কাদের খানের বিরোধ তৈরি হয়েছিল। কাদের খানের দাবি, এই টাকা তিনি এমপি থাকাকালে বরাদ্দ হয়েছিল। তাই তিনি ১৭ লাখ টাকা উত্তোলনও করেন, কিন্তু কোনো কাজ করেননি। এ নিয়ে জেলা পরিষদে আপত্তি দেন এমপি লিটন। এরপর প্রকল্পের বাকি টাকা তোলার জন্য আবেদন করেন কাদের খান, কিন্তু আপত্তির কারণে তুলতে পারেননি। তখন এ নিয়ে একটি প্রকল্পের সভাপতিকে দিয়ে আদালতে মামলা করান কাদের। ওই সভাপতি হলেন কাদেরের আত্মীয়। শেষ পর্যন্ত বাকি টাকা আর কেউ তুলতে পারেননি। এর বাইরে আর কোনো বিরোধের কথা জানা নেই সুজার।

পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, কাদের খান এক বছর ধরে লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যায় অংশ নেয়া চারজনকে একটি গুদামে ছয় মাস ধরে প্রশিক্ষণও দেন। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় কিলাররা। একপর্যায়ে হত্যার মোক্ষম সময় হিসেবে কাদের খানের নির্দেশে বছরের শেষ দিনকেই বেছে নেয় প্রশিক্ষিত কিলাররা। ‘আগামী নির্বাচনে নিজের পথ পরিষ্কার করতেই’ সাবেক এমপি কাদের খান এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে দাবি পুলিশের।

কে এই কাদের খান: কাদের খানের আদি বাসস্থান ময়মনসিংহ জেলায়। তার দাদা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি গ্রামে জমি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। কাদের খানের বাবার নাম হাসেন আলী খাঁ। তার (কাদের) স্ত্রী ডা. নাসিমা বেগম একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি চাকরি করছেন। ২০০৪ সালে কর্নেল পদ থেকে অবসর নেন কাদের।

এরপর তিনি বগুড়া শহরের রহমাননগরের জেলাদারপাড়ায় গরিব শাহ্ নামে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে স্ত্রীসহ তিনি রোগী দেখতেন। ওই ক্লিনিকের চতুর্থ তলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। এর পাশাপাশি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটি গ্রামের বাড়িতেও একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে সেখানে তিনি মাঝে মধ্যে থাকতেন।

পুলিশ ও স্থানীয়দের দেয়া তথ্যানুসারে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেই কাদের খান জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। পরে নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে লাঙল মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। যোগদানের সময় তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে তাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যানও করা হয়।

বগুড়া শহরে কাদের খানের বাড়ি

তবে সর্বশেষ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি জায়গা পাননি। জাপার দলীয় বিভাজনে পদ হারান তিনি। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কাদের খান পেশায় চিকিৎসক। মেডিসিনে এফসিপিএস ডিগ্রি নিয়েছেন। নির্বাচনের আগে এলাকায় রোগী দেখতেন, পরেও রোগী দেখতেন। এলাকার রোগীদের অনেকটা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। লিটন নিহতের পর গাইবান্ধা-১ আসনের আসন্ন উপনির্বাচনেও সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন এই সাবেক এমপি। পরে অবশ্য তিনি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। ডা. আবদুল কাদের খানের পৈতৃক বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর এলাকায়। তার পিতা নয়ান খাঁ ছিলেন পেশায় কৃষক।

পাঁচ ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে কাদের ছিলেন দ্বিতীয়। পরিবারের সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বড় ভাই অধ্যাপনা করেন, তৃতীয় ভাই গ্র্যাজুয়েট, চতুর্থ ভাই উপসচিব এবং পঞ্চম ভাই বিআরবি কেবলসের প্রকৌশলী। বোনেরা বিয়ের পর স্বামীর ঘরে রয়েছেন। তাদের পৈতৃক বাড়িটি বেশিরভাগ সময়ই নির্জন থাকে। এলাকায় তারা ধনাঢ্য পরিবার হিসেবে পরিচিত।

পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শুধু সরিয়ে দেয়া নয়, নানা কারণেই লিটনের ওপর বিরক্ত ছিলেন কাদের খান। ২০০৮ সালে মহাজোট থেকে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন কাদের খান। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন লিটন। তিনি নির্বাচিত হয়েই কাদের খানের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে দেন। দুদক এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে বলেও এলাকায় প্রচার আছে।

২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর মনজুরুল ইসলাম লিটন খুন হলে ওই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরই মধ্যে ওই আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে এবং আগামী ২২ মার্চ ভোটগ্রহণ হবে। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নেতা ডা. আবদুল কাদের খানও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তবে ওই আসনে জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কাদের খান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে প্রথমে রাজি হননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেননি। সেই সময় তিনি বগুড়া শহরের বাড়িতে পুলিশি পাহারায় অবরুদ্ধ ছিলেন।

চন্দন সরকারের খোঁজে পুলিশ: সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ দপ্তর সম্পাদক ও স্থানীয় সাংবাদিক চন্দন সরকারকে খুঁজছে পুলিশ। কাদের খানের জব্দ করা মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তার সঙ্গে চন্দন সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের দিন এমপি লিটনের অবস্থান এবং অনুকূল পরিবেশের খবর মোবাইল ফোনে ঘাতকদের জানান চন্দন। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী, কিলিং মিশন সফল করে খুনিরা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান চন্দন সরকার উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার পর থেকেই চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

ফলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি লিটন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। একদিন এমপি লিটন চন্দনকে প্রকাশ্যে চড়-থাপ্পড়ও মারেন। এ ক্ষোভে চন্দন সুন্দরগঞ্জে এমপি লিটনবিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এমপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ছাড়া সভা-সমাবেশে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। কাদের খান গ্রেপ্তারের পর থেকেই গা ঢাকা দেন চন্দন। জানা গেছে, চন্দন ইতোমধ্যে ভারতে চলে গেছেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!